হৈমন্তী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই উপলক্ষে হৈমর বাপের উদ্দেশে যাহা-না-বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটুকথার হাওয়া দিয়াছে, হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়াছে৷ একদিনের জন্য কাহারাে সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই। আজ তাহার বড়াে বড়াে দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল৷ সে উঠিয়া দাড়াইয়া বলিল, “আপনারা জানেন– সে দেশে আমার বাবাকে সকলে ঋষি বলে ?”

ঋষি বলে! ভরি একটা হাসি পড়িয়া গেল৷ ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ করিতে হইলে প্রায়ই বলা হইত, তােমার ঋষিবাবা! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল৷

বস্তুত, আমার শ্বশুর ব্রাহ্মও নন, খৃস্টানও নন, হয়তাে বা নাস্তিকও না হইবেন৷ দেবার্চনার কথা কোনােদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই৷ মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনােদিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনাে উপদেশ দেন নাই৷ বনমালীবাবু এ লইয়া তাহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন৷ তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি যাহা বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানাে হইবো”।

অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছােটো বােন নারানী৷ বউদিদিকে ভালােবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল৷ সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম৷ একদিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই৷ এ-সব কথা সংকোচে

সে মুখে আনিতে পারিত না৷ সে সংকোচ নিজের জন্য নহে৷৷

হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত৷ চিঠিগুলি ছােটো কিন্তু রসে ভরা৷ সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত৷ বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটিকে আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পূর্ণ হইতে পারিত না৷ তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনাে নালিশের ইশারাটুকুও ছিল না৷ থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত৷ নারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খােলা হইত৷

চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনাে প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে৷ বােধ করি তাহাতে তাঁহারা আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন৷ বিষম বিরক্ত হইয়া তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য ?” বাপই যেন সব, আমরা কি কেহ নই।” এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি মুগ্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, “তােমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়াে৷ কলেজে যাইবার সময় আমি পােস্ট করিয়া দিব।”

হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?” আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না৷

বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, “এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল৷ বি.এ. ডিগ্রি শিকায় তােলা রহিল৷ ছেলেরই বা দোষ কী?”

সে তাে বটেই৷ দোষ সমস্তই হৈমর৷ তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরাে ; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালােবাসি ; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্ত আকাশ আজ বাশি বাজাইতেছে।

বি.এ.ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায় দিতে পারিতাম কিন্তু হৈমর কল্যাণে পণ করিলাম, পাস করিবই এবং ভালাে করিয়াই পাস করিব। এ পণ রক্ষা করা আমার সে-অবস্থায় যে সম্ভবপর বােধ হইয়াছিল তাহার দুইটি কারণ ছিল– এক তাে হৈমর ভালােবাসার মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালােবাসার চারি

দিকে ভারি একটি স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত৷ দ্বিতীয়, পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার প্রয়ােজন তাহা হৈমর সঙ্গে একত্রে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না৷

পরীক্ষা পাসের উদ্যােগে কোমর বাঁধিয়া লাগিলাম৷ একদিন রবিবার মধ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া মার্টিনাের চরিত্রতত্ত্ব বইখানার বিশেষ বিশেষ লাইনের মধ্যপথগুলা ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেনসিলের লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময় বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়িল৷।

আমার ঘরের সমুখে আঙিনার উত্তর দিকে অন্তঃপুরে উঠিবার একটা সিঁড়ি৷ তাহারই গায়ে গায়ে মাঝে মাঝে গরাদে-দেওয়া এক-একটা জানলা৷ দেখি তাহারই একটি জানলায় হৈম চুপ করিয়া বসিয়া পশ্চিমের দিকে চাহিয়া৷ সে দিকে মল্লিকদের বাগানে কাঞ্চনগাছ গােলাপি ফুলে আচ্ছন্ন।

আমার বুকে ধক করিয়া একটা ধাক্কা দিল, মনের মধ্যে একটা অনবধানতার আবরণ ছিড়িয়া পড়িয়া গেল৷ এই নিঃশব্দ গভীর বেদনার রূপটি আমি এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই!

কিছু না, আমি কেবল তাহার বসিবার ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম৷ কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর-একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে, মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানাে, খােলা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। আমার বুকের ভিতরটা হুহু করিয়া উঠিল৷

আমার নিজের জীবনটা এমনি কানায় কানায় ভরিয়াছে যে, আমি কোথাও কোনাে শূন্যতা লক্ষ করিতে পারি নাই। আজ হঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহ্বর দেখিতে পাইলাম৷ কেমন করিয়া কী দিয়া আমি তাহা পূরণ করি৷

আমাকে তাে কিছুই ছাড়িতে হয় নাই৷ না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু হৈম-যে সমস্ত ফেলিয়া আমার কাছে আসিয়াছে৷ সেটা কতখানি তাহা আমি ভালাে করিয়া ভাবি নাই৷ আমাদের সংসারে অপমানের কন্টকশয়নে সে বসিয়া, সে শয়ন আমিও তাহার সঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছি৷ সেই দুঃখে হৈমর সঙ্গে আমার যােগ ছিল, তাহাতে আমাদিগকে পৃথক করে নাই। কিন্তু, এই গিরিনন্দিনী

সতেরাে বৎসরকাল অন্তরে বাহিরে কত বড় একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে৷ কী নির্মল সত্যে এবং উদার আলােকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কিরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুররূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এতদিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারি নাই, কেননা সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমান আসন ছিল না।

হৈম যে অন্তরে অন্তরে মুহূর্তে মুহূর্তে মরিতেছিল৷ তাহাকে আমি সব দিতে পারি কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না– তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায় ? সেইজন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ গরাদের ফাক দিয়া নির্বাক, আকাশের সঙ্গে তাহার নির্বাক মনের কথা হয় ; এবং এক-একদিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখি সে বিছানায় নাই ; হাতের উপর মাথা রাখিয়া আকাশ-ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাতে শুইয়া আছে৷

মার্টিননা পড়িয়া রহিল৷ ভাবিতে লাগিলাম, কী করি৷ শিশুকাল হইতে বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত ছিল না– কখনাে মুখােমুখি তাহার কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, “বউয়ের শরীর ভালাে নয়, তাহাকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।”

বাবা তাে একেবারে হতবুদ্ধি৷ মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে৷ তখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাসা করিলেন,“বলি, বউমা, তােমার অসুখটা কিসের।”

হৈম বলিল, “অসুখ তাে নাই।” বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য। কিন্তু, হৈমর শরীরও যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমরা প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই৷ একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, “অ্য, এ কী! হৈমী, এ কেমন চেহারা তাের! অসুখ করে নাই তাে ?”

হৈম কহিল, “না”

এই ঘটনার দিনদশেক পরেই, বলা নাই, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত৷ হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয় বনমালীবাবু তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন৷ | বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায় লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল৷ এবার মিলনের দিন বাপ যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের জল আর মানা মানিল না৷ বাপ একটি কথা বলিতে পারিলেন না, জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না ‘কেমন আছিস। আমার শ্বশুর তাঁহার মেয়ের মুখে এমন একটা-কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল৷

পোস্টটি শেয়ার করুন