হৈমন্তী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিশির– না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না৷ একে তাে এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে৷ সে সূর্যের মতাে ধ্রুব ; সে ক্ষণজীবিনী উষার বিদায়ের অশ্রুবিন্দুটি নয়৷ কী হইবে গােপনে রাখিয়া– তাহার আসল নাম হৈমন্তী৷৷
দেখিলাম, এই সতেরাে বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলাে আসিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনাে কৈশােরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই৷ ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের উপর সকালের আলাে ঠিকরিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু বরফ এখনাে গলিল না। আমি জানি, কী অকলঙ্ক শুভ্র সে, কী নিবিড় পবিত্র৷
আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া-জানা বড়াে মেয়ে, কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে৷ কিন্তু, অতি অল্পদিনেই দেখিলাম, মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোনাে জায়গায় কোনাে কাটাকাটি নাই৷ কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রঙ ধরিল, চোখে একটু ঘাের লাগিল,কবে যে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না৷
এ তাে গেল এক দিকের কথা। আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে৷৷ | রাজসংসারে আমার শ্বশুরের চাকরি৷ ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্তু কোনাে অঙ্কটাই লাখের নীচে নামে নাই৷ ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল,হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে থাকিল৷ আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না৷ এমন-কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিতে দিতেন না, তবু তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয়৷
এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পরিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘাের অন্ধকার দেখা গেল৷ ব্যাপারখানা এই– আমার বিবাহে আমার শ্বশুর পনেরাে হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন৷ বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর পাইয়াছেন, ইহার মধ্যে পনেরাে হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইয়াছে ; তাহার সুদও নিতান্ত সামান্য নহে৷ লাখ টাকার গুজব তাে একেবারেই ফাঁকি৷
যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনােদিন কোনাে আলােচনাই হয় নাই, তবু বাবা জানি না কোন্ যুক্তিতে ঠিক করিলেন, তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।
তার পরে, বাবার একটা ধারণা ছিল, আমার শ্বশুর রাজার প্রধান মন্ত্রী গােছের একটা-কিছু৷ খবর লইয়া জানিলেন, তিনি সেখানকার শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ। বাবা বলিলেন, অর্থাৎ ইস্কুলের হেডমাস্টার– সংসারে ভদ্র পদ যতগুলাে আছে তাহার মধ্যে সব চেয়ে ওঁচা৷ বাবার বড়াে আশা ছিল, শ্বশুর আজ বাদে কাল যখন কাজে অবসর লইবেন তখন আমিই রাজমন্ত্রী হইব।
এমন সময়ে রাস-উপলক্ষে দেশের কুটুম্বরা আমাদের কলিকাতার বাড়িতে আসিয়া জমা হইলেন৷ কন্যাকে দেখিয়া তাঁহাদের মধ্যে একটা কানাকানি পড়িয়া গেল৷ কানাকানি ক্রমে অস্ফুট হইতে স্ফুট হইয়া উঠিল৷ দূর সম্পর্কের কোনাে এক দিদিমা বলিয়া উঠিলেন, “পােড়া কপাল আমার! নাতবউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইলা”।
আর-এক দিদিমাশ্ৰেণীয়া বলিলেন, “আমাদেরই যদি হার না মানাইবে তবে অপু বাহির হইতে বউ আনিতে যাইবে কেন?”
আমার মা খুব জোরের সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, “ওমা, সে কি কথা৷ বউমার বয়স সবে এগারাে বৈ তাে নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারােয় পা দিবে৷ খােটার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।”
দিদিমারা বলিলেন,“বাছা, এখনাে চোখে এত কম তাে দেখি না৷ কন্যাপক্ষ নিশ্চয়ই তােমাদের কাছে বয়স ভাঁড়াইয়াছে।”
মা বলিলেন, “আমরা যে কুষ্ঠি দেখিলাম।” কথাটা সত্য। কিন্তু কোষ্ঠীতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়স সতেরাে৷ প্রবীণারা বলিলেন, “কুষ্ঠিতে কি আর ফাঁকি চলে না।” এই লইয়া ঘাের তর্ক, এমন-কি, বিবাদ হইয়া গেল।
এমন সময়ে সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত৷ কোনাে-এক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “নাতবউ, তােমার বয়স কত বললা তাে” | মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা করিলেন৷ হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না ; বলিল, “সতেরাে।”
মা ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি জান না”। হৈম কহিল,“আমি জানি, আমার বয়স সতেরাে।” দিদিমারা পরস্পর গা-টেপাটেপি করিলেন৷
বধুর নির্বুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা বলিলেন, “তুমি তাে সব জান! তােমার বাবা যে বলিলেন, তােমার বয়স এগারাে।”
হৈম চমকিয়া কহিল, “বাবা বলিয়াছেন ? কখনাে না।”
মা কহিলেন, “অবাক করিল৷ বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে কখনাে না?” এই বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন৷
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল৷ স্বর আরাে দৃঢ় করিয়া বলিল, “বাবা এমন কথা কখনােই বলিতে পারেন না।”
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, “তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস ?” হৈম বলিল, “আমার বাবা তাে কখনােই মিথ্যা বলেন না।”
ইহার পরে মা যতই গালি দিতে লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারি দিকে লেপিয়া গেল!
মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর মূঢ়তা এবং ততােধিক একগুয়েমির কথা বলিয়া দিলেন৷ বাবা হৈমকে ডাকিয়া বলিলেন,“আইবড়
মেয়ের মেয়ের বয়স সতেরাে, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক। পিটিয়া বেড়াইতে হইবে ? আমাদের এখানে এ-সব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি।”
হায় রে, তাঁহার বউমার প্রতি বাবার সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে এমন বাজখাঁই খাদে নাবিল কেমন করিয়া৷
হৈম ব্যথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “কেহ যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে কী বলিব।”
বাবা বলিলেন, “মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিয়াে ‘আমি জানি না, আমার শাশুড়ি জানেন।”
কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয় সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমন ভাবে চুপ করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন, তাঁহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ হইল৷
হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল৷ সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্রভাতের আকাশের মতাে তাহার চোখের সেই সরল উদার দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে ম্লান হইয়া গেছে৷ ভীত হরিণীর মতাে সে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, ‘আমি ইহাদিগকে চিনি না।
সেদিন একখানা শৌখিন-বাঁধাই-করা ইংরাজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিয়াছিলাম৷ বইখানি সে হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়া দেখিল না৷
আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, “হৈম, আমার উপর রাগ করিয়াে না৷ আমি তােমার সত্যে কখনাে আঘাত করিব না, আমি যে তােমার সত্যের বাঁধনে বাঁধা৷”
হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল৷ সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনাে কথা বলিবার দরকার নাই৷
পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পূজার্চনা চলিতেছে। এ পর্যন্ত সে-সমস্ত
ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূকে ডাক পড়ে নাই! নূতন বন্ধুর প্রতি একদিন পূজা সাজাইবার আদেশ হইল ; সে বলিল, “মা, বলিয়া দাও কী করিতে হইবে।”
ইহাতে কাহারাে মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল, মাতৃহীন প্রবাসে কন্যা মানুষ৷ কিন্তু কেবলমাত্র হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু৷ সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল, “ওমা, এ কী কাণ্ড। এ কোন্ নাস্তিকের ঘরের মেয়ে৷ এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই।”