হৈমন্তী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কোনাে একজন আনাড়ি কারিগরের তােলা ছবি৷ মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া খোঁপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই৷ ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা

একটি শাড়ি৷ কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না৷ যেমন তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডােরা-দাগ-কাটা শতরঞ্চ ঝােলানাে, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তােড়া৷ আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা৷

পটের ছবিটির উপর আমার মনের সােনার কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল৷ সেই কালাে দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল৷ আর, সেই বাঁকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল৷

পঞ্জিকার পাতা উলটাইতে থাকিল ; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। ও দিকে সামনে একটা অকাল-চার-পাঁচটা মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে৷ শ্বশুরের এবং তাঁহার মনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল৷

যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল৷ সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে৷ সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটিকে আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি৷ আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক।

বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোেল ; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল৷ এমন আশ্চর্য আর কী আছে৷ আমার মন বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, ঋআমি পাইলাম, “আমি ইহাকে পাইলাম। কাহাকে পাইলাম৷ এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে৷

আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর৷ যে হিমালয়ে বাস করিতেন সেই হিমালয়ের তিনি যেন মিতা৷ তাঁহার গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্র হইয়া ছিল৷ আর, তাঁহার হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে একটি প্রস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে চাহিত না৷

কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, আমার মেয়েটিকে আমি সতেরাে বছর ধরিয়া জানি, আর তােমাকে এই কটি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তােমার হাতেই ও রহিল৷ যে ধন দিলাম তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পার, ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই।”

তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বেহাই, মনে কোনাে চিন্তা রাখিয়াে না। তােমার মেয়েটি যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে, এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইলা”।

তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন ; বলিলেন,“বুড়ি চলিলাম৷ তাের একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খােওয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই।”

মেয়ে বলিল, “তাই বৈকি৷ কোথাও একটু যদি লােকসান হয় তােমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে”।

অবশেষে নিত্য তাঁহার যেসব বিষয়ে বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে-সম্বন্ধে সে বার বার সতর্ক করিয়া দিল৷ আহারসম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল

গুটিকয়েক অপথ্য ছিল, তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি– বাপকে সেই-সমস্ত প্রলােভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল৷ তাই আজ সে বাপের হাত ধরিয়া উদবেগের সহিত বলিল, “বাবা, তুমি আমার কথা রেখাে– রাখবে ?”

বাবা হাসিয়া কহিলেন, “মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য। অতএব কথা নােেদওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।” | তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল৷ তাহার পরে কী হইল কেহ জানে না।

বাপ ও মেয়ের অশ্রহীন বিদায়ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল ও শুনিল৷ অবাক কাণ্ড! খােট্টার দেশে থাকিয়া খােট্টা হইয়া গেছে! মায়ামমতা একেবারে নাই!

আমার শ্বশুরের বন্ধু বনমালীবাবুই আবাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন৷ তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত। তিনি আমার শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন, “সংসারে তােমার তাে ঐ একটি মেয়ে৷ এখন ইহাদেরই পাশে বাড়ি লইয়া এইখানেই জীবনটা কাটাও।”

তিনি বলিলেন, “যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম৷ এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে৷ অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতাে এমন বিড়ম্বনা আর নাই।”

সব শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতাে সসংকোচে বলিলেন, “আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ, এবং লােকজনকে খাওয়াইতে ও বড়াে ভালােবাসে৷ এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মাঝে মাঝে তােমাকে টাকা পাঠাইব। তােমার বাবা জানিতে পারিলে কি রাগ করিবেন।”

প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম৷ সংসারে কোনাে একটা দিক হইতে অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন, তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তাে দেখি নাই৷

যেন ঘুষ দিতেছেন এমনিভাবে আমার হাতে একখানা একশাে টাকার নােট গুজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত প্রস্থান করিলেন ; আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না৷ পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম, এইবার পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল৷ | আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম৷ মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ৷ বন্ধুদের অনেককেই তাে বিবাহ করিতে দেখিলাম৷ মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে গলাধঃকরণ করা হয়৷ পাকযন্ত্রে পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির নানা গুণাগুণ প্রকাশ হইতে পারে এবং ক্ষণে ক্ষণে আভ্যন্তরিক উবেগ উপস্থিত হইয়াও থাকে, কিন্তু রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে না৷ আমি কিন্তু বিবাহসভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরাে-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লােকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং জানেও না যে পায় নাই ; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না৷ কিন্তু, সে যে আমার সাধনার ধন ছিল ; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।

পোস্টটি শেয়ার করুন