হৈমন্তী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৈমন্তী
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনাে রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে৷ মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনাে তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া৷

আমি ছিলাম বর৷ সুতরাং, বিবাহসম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল৷ আমার কাজ আমি করিয়াছি, এফ.এ. পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি৷ তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল৷

আমাদের দেশে যে-মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোনাে উদবেগ থাকে না৷ নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে৷ অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনাে দ্বিধা থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের৷ বিবাহের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে, আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়৷

সত্য বলিতেছি, আমার মনে এমন বিষম উদবেগ জন্মে নাই৷ বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে হাওয়া দিতে লাগিল৷ কৌতুহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল৷ যাহাকে বার্কের ফ্রেঞ্চ রেভােলুশনের নােট পাঁচ-সাত খাতা মুখস্থ করিতে হইবে, তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের৷ আমার এ লেখা যদি টেকবুক-কমিটির অনুমােদিত হইবার কোনাে আশঙ্কা থাকিত তবে সাবধান হইতাম৷

কিন্তু, এ কী করিতেছি৷ এ কি একটা গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম৷ এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম৷ মনে ছিল, কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালাে হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার ঝােড়াে বৃষ্টির মতাে প্রবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব৷ কিন্তু, না পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে, কারণ সংস্কৃত মুগ্ধবােধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর, না পারিলাম কাব্য রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারে। সেইজন্যেই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বসিয়াছে৷ না করিয়া করিবে কী৷ তাহার-যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে৷ জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তাে জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রােদন৷

আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না৷ কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনাে আশঙ্কা নাই৷ যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খােদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট৷ কোনােকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে, এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না। কিন্তু, যে অমৃতলােকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগােনা নাই৷ | আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই৷ আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভােরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়৷

শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের ছােটো ছিল৷ অথচ, আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে৷ তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী ; দেশের প্রচলিত ধর্মকর্ম কিছুতে তাঁহার আস্থা ছিল না ; তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন৷ আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী ; মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে, সদরে বা অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ ইনিও কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন

মুর্তি। কোনােটাই সরল স্বাভাবিক নহে৷ তবুও বড়াে বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ, মেয়ের বয়স বড়াে বলিয়াই পণের অঙ্কটাও বড়াে৷ শিশির আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে৷ বাবার বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া

তুলিতেছে৷ | আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনাে একটা মতের বালাই ছিল না৷ তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোনাে রাজার অধীনে বড়াে কাজ করিতেন৷ শিশির যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়৷ মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড়াে হইতেছে, তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই৷ সেখানে তাঁহার সমাজের লােক এমন কেহই ছিল না যে তাহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে৷

শিশিরের বয়স যথাসময়ে যােলাে হইল ; কিন্তু সেটা স্বভাবের যােলাে, সমাজের ষােলাে নহে৷ কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না৷

কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল৷ বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাস করিবার পক্ষে যত ভালাে হউক, বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালাে নয়৷

বিবাহের অরুণােদয় হইল একখানি ফোটোগ্রাফের আভাসে৷ পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম৷ একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়াে– একেবারে ঘাড়মােড় ভাঙিয়া”।

পোস্টটি শেয়ার করুন