হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

সাত

নবীনগরের ছোট খালে এসে নাওয়ের নোঙ্গর ফেললো মন্তু।

খাল পাড়ে উঠে দাঁড়ালে টুনিদের বাড়ির লম্বা নারকেল আর তাল গাছগুলো দেখা যায়। আর সেই তাল নারকেলের বনের ফাঁকে ওদের দেউড়ি ঘরটাও চোখে পড়ে এখান থেকে।

নৌকো থেকে নামবার আগে মুখ হাত ভালো করে ধুয়ে নিলো মন্তু। পুরনো লুঙ্গিটা পালটে নিয়ে নতুন লুঙ্গিটা পরলো, ফতুয়াটা খুলে জামাটা গায়ে দিলো সে। তারপর খদ্দরের চাদরটা কাঁধে ফেলে, পুরনো ছাতাটা বগলে নিয়ে ধীরে ধীরে নৌকো থেকে নেমে এলো মন্তু।

কিছুদূর এসে পকেট থেকে টুপিটা বের করলো।

আসার সময় বুড়ো মকবুল বার বার করে বলে দিয়েছে; কুটুমবাড়িতে গিয়ে যেন মন্তু এমন কিছু না করে যার ফলে বাড়ির বদনাম হতে পারে। টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো মন্তু। পথঘাট জানা আছে ওর। এর আগে মকবুলের বিয়ের সময় একবার এসেছিল সে। দিন তিনেক থেকে গিয়েছে এখানে। রাস্তার দু’চারজন অপরিচিত লোক ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ওকে।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঝক ঝকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। একটু একটু করে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। এদিকের লোকেরা এর মধ্যে খেজুর গাছ কেটে রস নামাতে শুরু করে দিয়েছে। পথে আসতে তিন চারজন গাছুনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো মন্তুর।

ধারালো বাটাল দিয়ে গাছ কাটছে ওরা। তারপর মাটির কলসি ঝুলিয়ে দিয়ে নেমে আসছে গাছ থেকে।

টুনিদের বাড়ির সামনে এসে যার সঙ্গে মন্তুর প্রথম দেখা হলো সে টুনির চাচা মোতালেব শিকদার। সন্ধে বেলা গরু-বাছুরগুলোকে ঠেঙ্গিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে নিয় যাচ্ছিলো সে। মন্তুকে দেখে হা করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, মন্তু মিয়া না? কি মনে কইরা? মন্তু এগিয়ে এসে পা ধরে সালাম করলো ওর। তারপর বললো, ভাইজান পাঠাইছে, টুনু ভাবীরে নিবার লাইগা।

অ। মুখখানা ঈষৎ ফাঁক করে গরুগুলোকে ঠেঙ্গাতে ঠেঙ্গাতে আবার গোয়াল ঘরের দিকে চলে গেলো মোতালেব শিকদার।

একটু পরে আবার ফিরে এলো সে। বললো, আয়েন ভিতরে আয়েন। টুপিটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিলো মন্তু, তারপর শিকদারের পিছু পিছু ভেতর বাড়িতে এগিয়ে চললো সে।

দেউড়ির পাশে একখানা বাঁশের বেড়া দিয়ে বাইরের লোকদের কাছ থেকে ভেতর বাড়ির পর্দা রক্ষা করা হয়েছে। তারই পাশে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখের মধ্যে আঙ্গুল পুরে দিয়ে অলক চোখে দেখছে ওরা। ভেতর বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতে মন্তু দেখলো, ঘরের দাওয়ায় একটা বাঁশের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে টুনি। সারা মুখে ওর হাসি যেন উপচে পড়ছে। নীরবে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।

মন্তুকে টুনিদের ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল শিকদার।

রসুই ঘর থেকে টুনির মা বেরিয়ে এলেন বাইরে। মন্তু সালাম করলো তাকে।

মা বললেন, কইরে টুনি। মিয়ারে একখান জলচৌকি আইনা দে বউক।

চৌকি এনে দিলে দাওয়ায় বসলো মন্তু।

টুনির মা সবার কুশল জানতে চাইলো। টুনি কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, শুধু মুখ টিপে বারবার হাসতে লাগলো সে।

টুনির মা বললো, টুনি তো কদিন ধইরা যাওনের লাগি উথাল পাথাল লাগাইছে। উঁ যাইবো। যামু না আমি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো টুনি।

মা বললো, দাঁড়ায়া থাইকো না। মিয়ার অজুর পানি দাও।

মন্তুর জন্যে হাত-মুখ ধোয়ার পানি আনতে চলে গেলো টুনি। মা-ও গেলো একটু পরে, বললো তরকারিটা নামায়া আই।

চারপাশটা তাকিয়ে দেখছিলো মন্থ। এক বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে বাড়িটার। উঠোনের কোণে পাশাপাশি দুটো জাম গাছ ছিলো। কেটে ফেলা হয়েছে। রান্নাঘরের এ পাশটা নুয়ে পড়েছে এখন। আগে অমনটি ছিলো না। আগে গোয়াল ঘরটা পুকুরের পূর্ব পাশে ছিলো, এখন সেটা উত্তর পাশে সরিয়ে আনা হয়েছে।

টুনি এসে এক ঘটি পানি রাখলে ওর সামনে আর এক জোড়া খড়ম। বললো, হাতমুখ ধুইয়া নাও।

মন্তু মুখ হাত ধুয়ে নিলে ওর দিকে একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে টুনি বললো, চল ভেতরে চল, বাইরে শীত পড়ছে।

মন্তু কোন কথা বললো না। শান্ত শিশুর মত ওকে অনুসরণ করে ভেতরে চলে গেলো সে।

পাশাপাশি দুটো ঘর। মাঝখানে একটা দরজা। ও পাশেরটাতে মা-বাবা থাকে আর টুনির ছোট দুই ভাইরোন। এ পাশের ঘরটা দেখিয়ে টুনি মৃদু হেসে বললো, এইডা আমার ঘর।

ওর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো মন্তু। ছোট ঘর মালপত্র ভরা। কয়েকটা বড় বড় মাটির ঘটি এক কোণে রাখা, তার পাশে তিন চারটে বেতের ঝুড়ি। ঝুড়ি ভর্তি লাল আলু রাখা আছে। দক্ষিণ কোণে একটা কাঠের চৌকি। চৌকির উপরে একটা কথা বিছানো। একটা তেল চিটচিটে বালিশ। চৌকির নিচে দুটো ছোট ছোট টিনের প্যাটরা। পশ্চিমের বেড়ার সঙ্গে একটা কাঠের তাক বসানো হয়েছে। তাকের উপরে রাখা আছে কয়েকটা ছোট ছোট মাটির ভাড় আর একটা মুড়ির টিন। তার পাশে বেড়ার সঙ্গে একটা ভাঙা আয়না ঝােলান। উত্তর কোণে একটা দড়ির সঙ্গে ঝুলছে টুনির দুখানা শাড়ি, একটা ময়লা কথা। তাছাড়া ঘরের ঠিক মাঝখানে গিলে কাঠের সঙ্গে কতগুলো ছিকে। ছিকের মধ্যে কয়েকটা হাঁড়িপাতিল রাখা। মন্তু মুহূর্তে চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো ঘরটার ওপর। টুনি চৌকিটা দেখিয়ে বললো, এইখানে বও।

মন্তু বসলো।

কিছুক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে টুনি বললো, অমন শুকায়া গেছ ক্যান?

মন্তু পরক্ষণে বললো, কই না, শুকাই নাই তো।

টুনি মৃদু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

মন্তুর মনে হলো এ কমাসে টুনি অনেক পাল্টে গেছে। ওর দেহ পা আগের থেকে অনেক ভারী হয়ে গেছে আর গায়ের রঙে একটা চিকচিকে আভা জেগে উঠেছে। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে টুনি।

রাতে টুনির ঘরে ওর শোবার বন্দোবস্ত হলো।

ময়লা কাঁথাটার ওপর ওর একখানা শাড়ি বিছিয়ে দিলো। বালিশটাকে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দিলো। তারপর বললো, আর বইসা থাইকো না শুইয়া পড়।

মন্তু বললো, বেহান রাইতে কিন্তুক রওয়ানা দিতে হবে।

ওর কথা শেষ না হতে শব্দ করে হেসে দিলো টুনি।

বললো, ইস, কইলেই অইলো। তারপর একটুকাল থেমেই আবার বললো, সে কম কইরা অইলেও তিনদিন আমাগো বাড়ি বেড়ান লাগবে। তারপরে যাওনের নাম।

মন্তু বললো, পাগল অইছ? তাহলে ভাইজানে মাইরা ফালাইবো আমারে। করিম শেখের নাও নিয়ে আইছি। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। টুনি বললো, যাই শুই গিয়া, কথা যা অইবার কাল সকালে অইবো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল সে।

কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে একটু পরেই শুয়ে পড়লো মন্তু। করিম শেখের কথা মনে হতে আম্বিয়ার কথাও মনে পড়ছে তার।

এখান থেকে ফিরে যাওনের পথে টুনিকে সব বলবে মন্তু। টুনি নিশ্চয় এ ব্যাপারে সাহায্য করবে ওকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।

ঘুম ভাঙলো কখন সে ঠিক বলতে পারবে না। রাতের গভীর অন্ধকারে সে অনুভব করলো একটা হাত তার চুলগুলো নিয়ে খেলছে। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো মন্তু।

গনু মোল্লার কাছ থেকে নেয়া তাবিজটা বাহুতে বাধা আছে কিনা দেখলো। তারপরে কে যেন চাপা স্বরে ওকে ডাকলো, এই। সহসা কোন সাড়া দিলো না মন্তু।

হঠাৎ ওর হাতখানা শক্ত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলো সে। নরম তুলতুলে একখানা হাত।

একটা অস্পষ্ট কাতরোক্তি শোনা গেল, উঃ এই।

পরমুহূর্তে হাতখানা ছেড়ে দিলো মন্তু। টুনি?

ইস, কথা কয়ো না। মায় হুব। ওর মুখের ওপরে একখানা হাত রাখলো টুনি। তারপর মুখখানা আরো নামিয়ে আস্তে আস্তে করে বলো, চুপ, শব্দ কইর না। শোন, চুপচাপ উইঠা আইও আমার সঙ্গে।

কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মন্তু। টুনির মুখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। একটু পরে টুনির পিছু পিছু বাইরে বেরিয়ে এলো মন্তু।

বাইরে এসে দেখলো টুনির হাতে একষ্টা মাটির কলস। শীতে দুজনে রীতিমত কাপছিলো ওরা।

মন্তু প্রশ্ন করলো, কি, কি অইছে?

টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, কিছু অয় নাই, এদিকে আইও। ওর একখানা হাত ধরে অন্ধকারে টেনে নিয়ে চললো তাকে। বার বাড়িতে এসে মন্তু আবার প্রশ্ন করলো, কই চললা।

টুনি শব্দ করে হাসলো আবার, বললো, কলসি গলায় দিয়া দুইজনে পুকুরে ডুইবা মরুম চল। তার পরেই মন্ডুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সহসা প্রশ্ন করল সে, আমার সঙ্গে মরতা পিরবা না?

কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না মন্তু। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার হেসে উঠলো টুনি হাসির দমকে দেহটা বারবার দুলে উঠলো তার। বললো, ঘাবড়ায়গা না মিয়া তোমারে মারুম না। বলে আবার চলতে লাগলো সে।

এতক্ষণ এত অবাক হয়ে গিয়েছিলো মন্তু যে শীতের প্রকোপটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতে না যেতে প্রচণ্ড শীতে দাঁতে দাতে লেগে এলো ওর।

একটা লম্বা খেজুর গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো টুনি। কলসিটা মন্তুর হাতে দিয়ে বললো, এইটা রাখ হাতে।

তারপর পরনের শাড়িটা লুঙ্গির মতো গুটিয়ে নিল সে। মন্তু কাঁপা গলায় শুধালো কি কর?

ওর প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না টুনি। নির্বিকারভাবে খেজুর গাছটা বেয়ে উপরে উঠে গেলে সে।

মন্তুর মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে।

একটু পরে হাতে রসের হাড়িটা নিয়ে অন্য হাতে গাছ বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো টুনি। কলসির মধ্যে রসটা ঢেলে হাঁড়িটা রেখে আসবার জন্য আবার উপরে যাচ্ছিলো টুনি। মন্তু বললো, আরে কি করো। গাছ এখন পিচ্ছিল। পইড়া যাইবা।

পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসলো টুনি। বললো, ইস কত উঠছি। পাশের ঝােপ থেকে দুটো শিয়াল ছুটে এসে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মন্তুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখজোড়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ওদের। মন্তু একটা ধমক দিতে ছুটে পালিয়ে গেল ওরা।

টুনি নেমে এসে বললো, কারে ধমকাও?

মন্তু আস্তে করে বললে, শিয়াল।

আরো অনেকগুলো খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে কলসি ভর্তি করলো ওরা। শীতের রাতে কুয়াশার বৃষ্টি ঝরছে চারদিকে। মাটি ভিজে গেছে। গাছের পাতাগুলোও ভেজা। আশেপাশে তাকাতে গেলে বেশি দূরে দেখা যায় না। কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে চারদিক। হঠাৎ মনুর গায়ে হাত দিয়ে টুনি বললো, শীত লাগছে বুঝি? মন্তু কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, তোমার লাগে না?

টুনি বললো, উঁহু। বলে মাথাটা দোলাল সে।

মন্তু বললো, রস দিয়া করবা কি?

টুনি বললো, সিন্নি রান্দুম।

মন্তু কোন কথা বলার আগেই টুনি আবার বললো, তোমার নায়ে চল।

মন্তু অবাক হলো, নায়ে গিয়া কি করবা?

টুনি নির্লিপ্ত গলায় বললো, সিন্নি রান্দুম।

মন্তু বললো, পাগল হইছ?

টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, হুঁ। বলে মন্তুর মুখের দিকে তাকালো সে, কই নাওয়ে যাইবা না?

মন্তু কঠিন স্বরে বললো, না।

ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো টুনি। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তে একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো সে। হাতের কলসিটা উপরে তুলে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। মাটিতে পড়ে মাটির কলসি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

রস গড়িয়ে পড়লো চারপাশে।

কিছুক্ষণের জন্য দুজনে বোবা হয়ে গেলো ওরা।

কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরুলো না।

মন্তু নীরবে তাকিয়ে রইলো, ভাঙ্গা কলসির টুকরোগুলোর দিকে। টুনি মুখখানা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে পাথরের মত নিশ্চল দাড়িয়ে রয়েছে। পুকুর পাড়ে লম্বা তালগাছগুলোর মাথায় দুটো বাদুড় হঠাৎ পাখা ঝাঁপটিয়ে উঠলো।

টুনি আস্তে করে বললে, চল ঘরে যাই, চল।

মন্তু কোন কথা বললো না। নিঃশব্দে একে অনুসরণ করলো শুধু।

পরদিন যাওয়া হলো না মন্তুর।

টুনির মা বললো, কুটুমবাড়ি আইয়ে নিজের ইচ্ছায়, যায় পরের ইচ্ছায়। ইচ্ছা করলেই তো আর যাইতে পারব না মিয়া। যন যাইতে দিমু তহন যাইবা। অগত্যা থেকে যাওয়া হলো।

সারাদিন একবারও কাছে এলো না টুনি। অথচ সারাক্ষণ বাড়িতে ছিল সে। ঘরদোর ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ঘাটে গিয়ে বাসনপত্র ধুয়ে এনেছে। রান্নাবান্না করেছে।

তারপর খাওয়ার সময় মা ডেকে বলছে, কইরে টুনি এই দিকে আয়। মন্তু মিয়াকে ভাত বাইড়া দে। তখন শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থেকেছে সে।

রাতের বেলা হঠাৎ বেঁকে বসলো টুনি। বললো, কাল সক্কাল বেলাই চইলা যামু আমি।

জিনিসপত্র সব গুছাইয়া দাও।

মা বললো, আরো দুইটা দিন থাইকা যা। আবার কবে আইবার পারবি কে জানে।

টুনি বললো, না, মন্তু মিয়ার কাম কাজের ক্ষতি অইয়া যাইতেছে।

মা বললো, মন্তু মিয়াকে বুঝাইয়া কইছি। হে রাজী আছে।

টুনি তবু বললো, না, কাল সক্কালেই চইলা যামু।

পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনলো মন্তু।

পরদিন ভোরে রওয়ানা হয়ে গেলো ওরা।

মন্তু আর টুনি।

ওর বাবা আর চাচা দুই শিকদার খাল পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো ওদের সঙ্গে ছোট দুই ভাইবোনও এালো। আর এলো ওদের কাল কুকুরটা।

ছই-এর মধ্যে টুনির জন্যে কথাটা বিছিয়ে দিয়েছিলো মন্তু। তার ওপর গুটিমুটি হয়ে বসলো সে।

খালের পাড়ে যতক্ষণ তার বাবা চাচা আর ভাইবোনদের দেখা গেলো ততক্ষণ সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো টুনি।

তারপর মুখখানা ঘুরিয়ে এনে নীরবে বসে রইলো।

খাল পেরিয়ে যখন নৌকা নদীতে এসে পড়লো তখন দুপুর হয়ে আসছে।

টুনি এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। মন্তু সারাক্ষণ কথা বলার জন্য অ্যাঁকুপাকু করছিলো। কিন্তু একবার সুযোগ দিলো না টুনি। উজান নদীতে দাঁড় বেয়ে চলতে চলতে এক সময়ে মন্তু বললো, বাইরে আইয়া বহো, গায়ে বাতাস লাগবে।

ও নড়েচড়ে বসলো কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এলো না।

একটু পরে একটা কাপড়ের পুটলি থেকে কিছু চিড়া আর এক টুকরো খেজুরের গুড় বের করে এর দিকে এগিয়ে দিলো টুনি। বললো, বেলা অইয়া গেছে-খাইয়া নাও। বলে আবার চুপ করে গেলো সে।

মন্তু বললো, তুমি খাইবা না?

না।

না কেন?

ক্ষিধা নাই।

ঠিক আছে আমারও ক্ষিধা নাই। বলে আবার দাঁড় বাইতে লাগলো মন্তু। নদীর পানিতে দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না।

ক্ষণকাল পরে টুনি আবার বললো, খাইবা না।

না।

শেষে শরীর খারাপ করবো।

করুক গা। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো মন্তু।

আর বেশিক্ষণ ছইয়ের ভেতর বসে থাকতে পারলো না টুনি। অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এলো সে, চিড়ার বাসনটা তুলে নিয়ে ওর সামনে এসে বসলো।

নাও, খাও।

কইলাম তো খামু না।

তাইলে কিন্তু পানির মধ্যে সব ফালাইয়া দিমু আমি। টুনি ভয় দেখালো ওকে।

মন্তু নির্বিকার গলায় বললো, দাও ফালাইয়া।

কিন্তু ফেললো না টুনি। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো সে। হাসির দমকে মাথার ঘোমটাটা খসে পড়লো কাঁধের ওপর।

টুনি বললো, আমি খাওয়াইয়া দিই।

মন্তু বললো, না।

টুনি বললো, তাহলে তুমি নিজ হাতে খাও। আমিও খাই। বলে এক মুঠো চিড়ে মুখের মধ্যে পুরে দিলো সে।

মন্তুর মুখেও এক ঝলক হাসি জেগে উঠলো। এতক্ষণে টুনির কোলের ওপরে রাখা বাসন থেকে এক মুঠো চিড়ে নিয়ে সেও মুখে পুরলো।

টুনি বললো, গুড় নাও। খাজুরি গুড়।

চিড়ে খেতে খেতে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সহজ হয়ে এলো টুনি।

এক ফাঁকে ওকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি পৌঁছাইতে কতক্ষণ লাগবো?

মন্তু একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, মাইজ রাতে।

বেশ জোরে দাঁড় বাইছিলো মন্তু।

সেই হঠাৎ টুনি বললো, এত তাড়াতাড়ি কই কেন? আস্তে বাও না।

মন্তু বললো, তাইলে বাড়ি যাইতে তিনদিন লাগবো।

লাগে তো লাগুক না। টুনির কণ্ঠরে চরম নির্লিপ্ততা।

মন্তু কোন জবাব দিলো না। ‘

আঁজলা ভরে নদীর পানি পান করলো ওরা। তারপর ছইয়ের বাইরে বসে টুনি দু’হাতে নদীর পানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো। দু’পাশে অসংখ্য গ্রাম। একটার পর একটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝে মাঝে রবি-শস্যের ক্ষেত, নারকেল আর ঘন সুপারির বন। জেলেদের পাড়া।।

ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে মাঝ নদীতে এসে জাল ফেলেছে ওরা।

একখানা হাত পানির মধ্যে ছেড়ে দিয়ে টুনি বললো, তুমি এইবার জিরাও।

আমি দাঁড় টানি।

মন্তু হেসে বললো, পাগল নাকি?

টুনি বললো, ক্যান?

মন্তু বললো, অত সহজ না, দাঁড় বাইতে ক্ষেমতার দরকার আছে।

টুনি আবার চুপ করে গেলো।

বিকেলের দিকে শান্তির হাটের কাছাকাছি এসে পৌছলো ওরা। নদী এখন দম ধরেছে। পানিতে আর সেই স্রোত নেই। একটা থমথমে ভাব। একটু পরে জোয়ার আসবে। তখন আর নৌকো নিয়ে এগোন যাবে না, কুলে এনে বেঁধে রাখতে হবে। তারপর জোয়ার নেমে গিয়ে ভাটা পড়লে তখন আবার নৌকো ছাড়বে মন্তু।

দূর থেকে শান্তির হাটটা দেখা যাচ্ছে।

অসংখ্য লোক গিজগিজ করছে সেখানে।

ওদিকে তাকিয়ে টুনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ওইহানে কি?

মন্তু বললো, ওইটা শান্তির হাট।

টুনি পানি থেকে হাতটা তুলে নিয়ে অপূর্ব ভঙ্গী করে বললো, ওইহানে চুড়ি পাওন যায়?

আমারে কিননা দিবা?

মন্তুর ইচ্ছে জোয়ার আসার আগে শান্তির হাটে গিয়ে নৌকো ভিড়াবে। তাই সংক্ষেপে বললো, হুঁ দিমু।

শান্তির হাটে পৌছে, একটা নিরাপদ স্থান দেখে নৌকো বাঁধলো মন্তু।

নদীর পাড়ে খালি জায়গাটায় তবু পড়ছে একটা। বিচিত্র তার রঙ।

বাইরে ব্যান্ড পার্টি বাজছে খুব জোরে জোরে। চারপাশে লোকজনের ভিড়। হাটের কাছে আসার পর থেকে ছইয়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে টুনি।

সেখান থেকে মুখ বের করে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, ওইহানে কি?

মন্তু বললো, সার্কাস পার্টি। সার্কাস পার্টি আইছে।

সেদিকে তাকিয়ে থেকে টুনি আবার বললো, সেইটা আবার কি?

মন্তু বললো, নানা রকম খেলা দেহায় ওরা। মানুষের খেলা, বাঘের খেলা। আর কত কি! বাঘের নাম শুনে ভয় পেয়ে গেলো টুনি। কিন্তু পরক্ষণেই বললো, আমারে দেহাইবা?

মন্তুর কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু হাটের মধ্যে মেয়ে মানুষ নিয়া যাওয়াটা সমীচীন মনে হলো না ওর। তাই বললো, না, তোমার যাইয়া কাজ নাই। তুমি বহ, আমি আইতাছি। ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছইয়ের বাইরে এলো টুনি। বললো, ওমা, আমি একলা থাকবার পারমু না এহানে। তুমি যাইও না।

মুহূর্তে নিরাশ হয়ে গেলো মন্তু। ও নিজে এর আগে কোনদিন সার্কাস দেখেনি। ভেবেছিলো এই সুযোগে দেখে নিবে। কিন্তু টুনির কথায় ভেঙ্গে পড়লো সে। সার্কাসের তাবুর দিকে চোখ পড়তে দেখলো শুধু পুরুষ নয়, অসংখ্য মেয়েছেলেও দলে দলে ঢুকছে এসে তাঁবুর মধ্যে।

মন্তু কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, আই, দেরি কইরো না, আহ।

ওর পিছু পিছু নিচে নেমে এলো টুনি। মাথার ঘোমটাটা সে এক হাত লম্বা করে দিয়েছে।

আর সেই ঘোমটার ভেতর দিয়ে বিস্ময় বিমুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে সে।

তাঁবুর সামনে বড় বড় দুটো হ্যাজাক জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। এক পাশে এক এক দল লোক ব্যান্ড বাজাচ্ছে।

তাবুর দরজার উপরে একটা মাচায় চড়ে দুটি মেয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। সারা গায়ে, মুখে নানারকমের রঙ মেখেছে ওরা। টুনি অবাক হয়ে বললো, ওমা শরম করে না।



মন্তু বললো, শরম করবে ক্যান, ওরা মাইয়া লোক না, পুরুষ মানুষ মাইয়্যা সাজছে। অ। হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো টুনি।

দরজায় দাঁড়ান লোকটার কাছ থেকে তিন আনা দামের দু’খানা টিকেট কাটলো মন্তু। ভেতরে ঢুকে দেখে ছেলে বুড়ো মেয়েতে তিল ধারণের জায়গা নেই। তাবুর একটা কোণে অল্প একটু জায়গা নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লো ওরা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সার্কাস শুরু হয়ে গেলো।

প্রথমে একটা মেয়ে দুটো লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা একখানা দড়ির উপর দিয়ে নির্বিকারভাবে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে হেঁটে চলে গেলো।

লোকেরা হাতে তালি দিয়ে উঠলো জোরে।

তারপর আসলো বিকটাকার লোক। হাতের মুঠোর উপরে তিনটে মানুষকে তুলে নিয়ে চরকির মত ঘোরাতে লাগলো সে।

সবাই এক সঙ্গে বাহবা দিয়ে উঠলো।

এরপরে খুব জোরে ব্যান্ড বাজলো কিছুক্ষণ।

তার পরেই এলো বাঘ। এসেই একটা হুঙ্কার ছাড়লো সে।

মন্তুর একখানা হাত ওর মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখলো টুনি। দুচোখে ওর অপরিসীম বিস্ময়। ঘোমটার ফাঁকে একবার চারপাশের দর্শকের দিকে তাকালো সে। তাকালোমর দিকে। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো বাঘের ওপর।

ইতিমধ্যে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে মন্তুর বুকের মধ্যে সিঁধিয়ে গেছে টুনি।

মন্তু নিজেও জানে না কখন টুনিকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে সে। সার্কাস শেষ হতে দু’জনের চমক ভাঙলো। শক্ত করে ধরে রাখা মন্তুর হাতখানা মুহূর্তে ছেড়ে দিলো টুনি। তারপর মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মন্তু নিজেও কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।

ইতস্তত করে বললো, চলো।

ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ঘাটে আসার পথে মোয়র হাজীর চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসতে হয়। মন্তুকে দেখে হাজী দোকান থেকে চিৎকার করে উঠলো, আরে মন্তু মিয়া, কই যাও, শুন শুন?

মন্তু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, পারলো না।

আরে মিয়া কাজের কথা আছে শুইনা যাও। দু’হাতে ওকে কাছে ডাকলো মনোয়ার হাজী।

টুনি পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো মন্তু। কাউন্টারে আরো অনেকগুলো লোক কথা বলছিলো।

হঠাৎ মনোয়ার হাজী শব্দ করে হেসে উঠে বললো, বাহরে বাহ বিবিজানরে সঙ্গে নিয়ে সার্কাস দেখবার আইছ বুঝি?

সঙ্গে সঙ্গে আটজোড়া চোখ অদূরে দাঁড়ান টুনির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলো।

মন্তু কিছু বলবার আগেই মনোয়ার হাজী সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো, কহন করলা, অ্যাঁ?

একবার খবর দিলা না। দাওয়াত করলা না, এইডা কেমুন কথা?

হতবুদ্ধি মন্তু কি করবে কিছু ভেবে পেলো না। সে শুধু ইতস্তত করে একবার মনোয়ার হাজীর দিকে আরেকবার টুনির দিকে তাকালো বার কয়েক। এক বিচিত্র অনুভূতির আবেশে

একটা ঢোক গিলে মন্তু বললো, কিছু চুড়ি কিনন লাগব।

হ্যাঁ, তা কিনবা না, নিশ্চয় কিনবা। একগাল হাসলো মনোয়ার হাজী। তারপর বললো, এহন চল মিয়া ভাবীরে নিয়া আজকা রাতে আমাগো বাড়ি মেহমান অইবা।

মন্তু পরক্ষণে বাধা দিলো, না না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরন লাগবো। ওর কথাটা কানে নিলো না মনোয়ার হাজী। সে জানালো থাকার কোন অসুবিধা হবে না ওদের। বাড়ি ঘর আছে অনেকগুলো, তারই একটিতে সুন্দর করে বিছানা পেতে দেবে। তাতে যদি মন্তুর আপত্তি থাকে তাহলে, আর একটা ভাল বন্দোবস্ত করে দিতে পারে নোয়ার হাজী। সার্কার্স পার্টির ওখানে হোটেল উঠেছে কয়েকটা। এক একটা ঘর এক টাকায় এক রাতের জন্যে ভাড়া দেয় ওরা। সেখানেও ইচ্ছে করলে থাকতে পারে মন্তু। পান-খাওয়া দাঁতগুলো বের করে মনোয়ার হাজী বললো, আরে মিয়া নতুন বউ নিয়া যদি একটু ফুর্তি না কইরলা তাইলে চলে কেমন কইরা। এইতো বয়স তোমাগো।

এই শীতেও ঘামিয়ে উঠেছে মন্তু। টুনির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, ও ভীষণ ব্রিত বোধ করছে।

ক্ষণকাল পরে মন্তু বললো, আরেকদিন আইসা আপনাগো বাড়ি মেহমান হমু। আজকা। যাই।

ওর আমন্ত্রণ রক্ষা না করার জন্যে কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করলো মনোয়ার হাজী। অবশেষে বললে, আরেকদিন কিন্তুক আইবা মিয়া। আর হ্যাঁ, ভাবী সাহেবরে সঙ্গে নিয়া আইবা কিন্তুক। বলতে বলতে টুনির দিকে তাকালো হাজী।

জোয়ার পড়ে যাওয়ায়, ভাটার পানি অনেক নিচে নেবে গেছে। যেখানে নৌকোটা বেঁধে রেখে গিয়েছিলো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ওটা। মাঝখানের জায়গাটা পানি আর কাদায় ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। ওর ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে অতি সাবধানে আঙ্গুলের নখগুলো দিয়ে মাটি চেপে রাখতে হয়। নইলে যে কোন মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

নিচে নামতে গিয়ে অন্ধকারে মন্তুর ফতুয়াটার একটি কোণ শক্ত করে ধরে রেখেছে টুনি। একটু অসতর্ক হতে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো সে। মন্তু ধরে ফেললো। মাথার অ্যাঁচলটা কাঁধের উপরে গড়িয়ে পড়লো, একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করলো টুনি। কাঁধের উপর থেকে ওর মুখখানা সরিয়ে দিতে গিয়ে মন্তু সহসা অনুভব করলো, টুনির দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। নিঃশব্দে কাঁদছে টুনি!

ভাটি গাঙে নাও ভাসিয়ে দিয়ে বসে রইলো মন্তু। মনটা আজ ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে ওর। সারা দেহে আশ্চর্য এক অবসাদ। সেদিন রাতে রসের কলাসটা ভেঙ্গে ফেললো টুনি তখনও এত খারাপ লাগে নি ওর। আজ কেমন ব্যথা অনুভব করছে সে। বুকের নিচটায়। কলজের মধ্যে।

নৌকোর ছইয়ের ভেতরে চুপচাপ বসে রয়েছে টুনি। একটা কথা বলছে না সে, একটু হাসছে না।

হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলে মন্তু।

বন্ধুরে আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করিমু তোমার সনে।
তোমারে নিয়া ঘর বাঁধিমু গহিন বালুর চরে।
ও পরাণের বন্ধুয়ারে।।

নদীর স্রোত নৌকোর গায়ে ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। যেন বহুদিনের এই স্নেহের টানকে চিরন্তন করে ধরে রাখার জন্যে প্রাণহীন কাঠের টুকরোগুলোকে গভীর আবেগে বারবার জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওরা। টুনি এখনো নীরব।

খালের মুখের কাছে নৌকো থামাতে হলো।

ভাটার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। পাতা পানিতে নৌকা নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না। এখানে অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না আবার জোয়ার আসে। জোয়ারের স্রোতে নৌকো নিয়ে ভেতরে চলে যাবে মন্ত। কিন্তু সে এখনো অনেক দেরি। ভোর রাতের আগে জোয়ার আসবে না।

নৌকো থামাতে দেখে টুনি এতক্ষণে কথা বললো, কি, নাও থামাইল্যা ক্যান?

হঠাৎ নিজের অজান্তে একটা কথা বলে বসলো মন্তু। বললো, বাড়ি যামু না। এইহানে থাকুম আমরা।

ক্যান? ক্যান? টুনির কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।

শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো মন্তু। ওর হাসিটা কাটা বাঁশের বাঁশির মতো শোনাল।

নৌকো থেকে নোঙরটা তুলে নিয়ে নিচে নেবে গেলো মন্তু। ভালো করে মাটিতে পাতলো ওটা। নইলে জোয়ারের প্রথম ধাক্কায় মাঝ নদীতে চলে যাওয়ার ভয় আছে। তারপর পা জোড়া ধুয়ে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে টুনির প্রশ্নের উত্তর দিলো মন্তু।

জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে ওদের।

এইহানে? বলতে গিয়ে চারপাশে তাকালো টুনি।

আশেপাশে কোন জনবসতি নেই। দক্ষিণে যতদূর তাকানো যায় অথৈ পানির ঢেউ। নদী এখানে বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে সাগরের দিকে। কয়েকটি জেলে নৌকো মাঝ নদীতে টিমটিম বাতি জ্বালিয়ে জাল পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একে অন্যকে জোর গলায় ডাকছে ওরা। নিশীর বাপ জাইগা আছনি, ও নিশীর বাপরে কুই-কুই।

পশ্চিমে চর পড়েছে। বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে কোন লোকালয় নেই। শুধু বালু আর বালু। তার উপরে আরো এগিয়ে গেলে সীমাহীন বুনো ঘাসের বন। দিনের বেলায় অসংখ্য গরু বাছুর নিয়ে রাখাল ছেলেরা আসে এখানে, রাতে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে থাকে সমস্ত প্রান্তর।

পুবে, ফেলে আসা নদী এঁকে-বেঁকে চলেছে শান্তির হাটের দিকে।

উত্তরে খাল। খালের পারে অসংখ্য বুনো ফুলের বন। একটু ভালো করে তাকালে ওপারে তৈরি লম্বা সাঁকোটা নজরে আসে এখান থেকে। চারপাশে এক পলক তাকিয়ে চুপ করে গেলো টুনি।

ও মাঝি। মাঝ-ও-কু-ই। জেলে নৌকো থেকে কে যেন ডাকলো, কোন হানের নাও।

অ্যাঁ?

গলা চড়িয়ে মন্তু জবাব দিলো, পরীর দীঘি।

জবাব শুনে চুপ করে গেলো জেলেটা।

এতক্ষণ নৌকো বেয়ে আসছিলো বলে শীতের মাত্রাটা বুঝে উঠতে পারে নি মন্তু।

তাড়াতাড়ি ছইয়ের মধ্যে এসে ঢুকলো সে।

টুনি নড়েচড়ে একপাশে সরে গেলো।

ছইয়ের সঙ্গে ঝোলান হুঁকো আর কটো নামিয়ে নিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে এক ছিলিম তামাক ধরিয়ে নিল মন্তু। তারপর আবার বাইরে বেরিয়ে এসে গলুইয়ের উপর আরাম করে বসে তামাক টানতে লাগলো।

দক্ষিণ থেকে কনকনে বাতাস বইছে জোরে।

আকাশে মেঘ।

মেঘের ফাঁকে আধখানা চাদ মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার মুখ লুকুচ্ছে তাড়াতাড়ি।

টুনি ডাকলো, ওইহানে বইসা ক্যান, ভেতরে আহ।

মন্তু কোন জবাব দিলো না। আপন মনে হুঁকো টানতে লাগলো সে।

টুনি আবার ডাকলো, আহ না, বাইরে ঠাণ্ডা লাগবো।

মন্তু নীরব।

আইবা না? টুনির কণ্ঠে অভিমান।

বাইরে বেরিয়ে এসে ওর হাত থেকে কোটা নিলো টুনি। চলো, ভেতরে গিয়া শুইবা।

এবার আর কোন বাধা দিলো না। নিঃশব্দে ছইয়ের ভেতর গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। ওর গায়ের উপর কথাটা টেনে দিয়ে মাথার কাছে চুপচাপ বসে রইল টুনি।

বাইরের কনকনে বাতাস শূন্য প্রান্তরের উপর দিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে দূর থেকে দূরে। সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে বসে রইলো।

ভোরে ভোরে গ্রামে এসে পৌঁছল ওরা।

মন্তু আর টুনি। পরীর দীঘির পাড়ে তিনটে নতুন কবর।

দূর থেকে দেখে বুক কেঁপে উঠলো তার। নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, কে মরলো?

ঘোমটার নিচে থেকে টুনিও চোখ বড় বড় করে দেখছিলো কবরগুলো। পথে আসতে মাঝি বাড়ির কুদুসের সঙ্গে দেখা হতে সব শুনলো মন্তু। প্রথম কবরটা এ গাঁয়ের তোরাব আলীর। আশির উপর বয়স হয়েছিলো ওর। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে চলাফেরা করতে পারতো না। মরে বেঁচেছে বেচারা। নইলে আরো কষ্ট সহ্য করতে হতো।

দ্বিতীয় কবরটা আসকর ফকিরের। পেটে পিলে হয়েছিলো। প্রায়ই রক্তবমি করতো।

বুড়োরা বলতো, শত্রুপক্ষ কেউ তাবিজ করেছে, নইলে, অমন হবে কেন।

তার পাশের কবরটা হালিমার। আবুলের বউ হালিমা। গতকাল দুপুরে ঘরের মধ্যে হঠাৎ চিতল মাছের মত তড়পাতে তড়পাতে মারা গেছে হালিমা।

মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো মন্তুর।

হালিমার মৃত্যুর সংবাদে কাঁদতে শুরু করেছে টুনি। ঘোমটার নিচে ফুপিয়ে কাঁদছে সে।

ইতস্তত করে মন্তু বললো, কান্দ কান, কাইন্দা কি অইবে।

বাড়ি ফিরে এলে বুড়ো মকবুল গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করলে একদিন নয়, দুদিন নয়, চার চারটে দিন। দুশ্চিন্তায় বারবার ঘর-বার করেছে সে। আইতে এত দেরি অইলো ক্যান? অ্যাঁ।

মন্তু খুলে বললো সব। কুটুম বাড়িতে গিয়ে কুটুম যদি আসতে না দেয় তাহলে কি করতে পারে সে? তাছাড়া নদীতে যে জোয়ার ভাটা আসে সেটাও কারো ইচ্ছেমত চলে না। তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে ওদের। মকবুল শুনলে সব, শুনে শান্ত হলো। তারপর কোদালটা হাতে তুলে নিয়ে বাড়ির উপরের ক্ষেতটার দিকে চলে গেলো সে। যাবার পথে আমেনাকে আর ফাতেমাকে ডেকে গেলো মকবুল। মাটি কুপিয়ে সমান করে মরিচের চারা লাগাতে হবে।

পোস্টটি শেয়ার করুন