সুভা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুভা
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বােবা হইবে। তাহার দুটি বড় বােনকে সুকেশিনী ও সুহাসিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরােধে তাহার বাপ ছােটো মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখে। এখন সকলে তাহাকে সংক্ষেপে সুভা বলে।

দস্তুরমতাে অনুসন্ধান ও অর্থব্যয়ে বড়াে দুটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গেছে, এখন ছােটোটি পিতামাতার নীরব হৃদয়ভারের মতাে বিরাজ করিতেছে।

যে কথা কয় না সে যে অনুভব করে ইহা সকলের মনে হয় না, এইজন্য তাহার সাক্ষাতেই সকলে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিত। সে যে বিধাতার অভিশাপরূপে তাহার পিতৃগৃহে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে এ কথা সে শিশুকাল হইতে বুঝিয়া লইয়াছিল। তাহার ফল এই হইয়াছিল, সাধারণের দৃষ্টিপথ হইতে সে আপনাকে গােপন করিয়া রাখিতে সর্বদাই চেষ্টা করিত। মনে করিত, আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচি। কিন্তু, বেদনা কি কেহ কখনাে ভােলে। পিতামাতার মনে সে সর্বদাই জাগরূক ছিল।

বিশেষত, তাহার মা তাহাকে নিজের একটা ত্রুটিস্বরূপ দেখিতেন , কেননা, মাতা পুত্র অপেক্ষা কন্যাকে নিজের অংশরূপে দেখেন— কন্যার কোনাে অসম্পূর্ণতা দেখিলে সেটা যেন বিশেষরূপে নিজের লজ্জার কারণ বলিয়া মনে করেন। বরঞ্চ, কন্যার পিতা বাণীকণ্ঠ সুভাকে তাহার অন্য মেয়েদের অপেক্ষা যেন একটু বেশি ভালােবাসিতেন; কিন্তু মাতা তাহাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক জ্ঞান করিয়া তাহার প্রতি বড়ো বিরক্ত ছিলেন।

সুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট বড় বড় দুটি কালাে চোখ ছিল এবং তাহার ওষ্ঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতাে কাঁপিয়া উঠিত।

কথায় আমরা যে ভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতাে; সকল সময়ে ঠিক হয় না, ক্ষমতা-অভাবে অনেক সময়ে ভুলও হয়। কিন্তু, কালাে চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না— মন আপনি তাহার উপরে ছায়া ফেলে; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনাে প্রসারিত কখনাে মুদিত হয়। কখনাে উজ্জ্বলভাবে জলিয়া উঠে, কখনাে ম্লানভাবে নিবিয়া আসে; কখনাে অস্তমান চন্দ্রের মতাে অনিমেষভাবে চাহিয়া থাকে, কখনাে দ্রুত চঞ্চল বিদ্যুতের মতাে দিগ্‌বিদিকে ঠিকরিয়া উঠে। মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নাই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর— অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতাে, উদয়াস্ত এবং ছায়ালােকের নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতাে একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না। সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতাে শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন।

পোস্টটি শেয়ার করুন