॥ ২ ॥
সুজন বাড়ি ফিরে এসে মা-বাবাকে সব কথা বলল। দিবাকর ত মহাখুশি। বলল, এইবার ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। তোর বোধ হয় একটা হিল্লে হল।
মা বলল, ‘তুই যে যাবি, আর ফিরবি না নাকি?’
‘পাগল!’ বলল সুজন। ‘কাজ হয়ে গেলেই ফিরব। আর নাম-ডাক হলে মাঝে মাঝে বেরিয়ে যাব, মাঝে মাঝে ফিরব।’
পরদিন ভোর থাকতে সুজন বেরিয়ে পড়ল। যখন চাঁড়ালির বনে পৌঁছাল তখন সূর্য তাল গাছের মাথা ছাড়িয়ে খানিকদূর উঠেছে। বনের ধারে একটু খুঁজতেই একটা খোলা জায়গায় জবরনগরের রাজার তাঁবু দেখতে পেল সুজন। রাজা দেশে ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হয়েই বসে আছেন। বললেন, ‘তোকে একটা ঘোড়ায় তুলে নেবে আমার লোক, তুই তার সঙ্গেই যাবি!’
সুজনকে আগে ভালো ভালো মিঠাই আর ফল-মূল খেতে দিয়ে রাজা পাত্রমিত্র সঙ্গে করে রওনা দিলেন জবরনগর। ঘোড়ার পিঠে কোনোদিন চড়েনি সুজন, যদিও ঘোড়ার ডাক তার শেখা আছে। মহা আনন্দে রোদ থাকতে থাকতেই সুজন পৌঁছে গেল জবরনগর।
গাছপালা দালান-কোঠা পুকুর বাগান হাট-বাজারে ভরা এমন বাহারের শহর সুজন কখনো দেখেনি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করে তার ভারী আশ্চর্য লাগল। সে রাজাকে জিগ্যেস করল, ‘এত গাছপালা, এত বাগান, তবু একটাও পাখির ডাক নেই কেন?
রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সে যে কত বড় দুঃখের কথা সে কী বলব তোকে। ওই যে দূরে পাহাড় দেখছিস, ওই পাহাড়ের নাম আকাশী। ওই পাহাড়ের গুহায় একটা রাক্ষস না খোক্কস না জানোয়ার কী জানি এসে রয়েছে আজ পাঁচ বছর হল। তার খাদ্যই হল পাখি। সে যে কী জাদু করে তা জানি না, পাখিরা সব আপনা থেকে দলে দলে উড়ে গিয়ে তার গুহায় ঢোকে, আর রাক্ষসটা তাদের ধরে ধরে খায়। এখন এই শহরে আর কোনো পাখি বাকি নেই। কেবল একটা হীরামন আছে আমার মেয়ের খাঁচায় রাজবাড়ির অন্দরমহলে।’
‘কিন্তু তার খাবার ফুরিয়ে গেলে সে রাক্ষস বাঁচবে কি করে?’
‘খাবার কি আর সে শুধু আমার শহর থেকে নেয়? পাহাড়ের উত্তরে আছে আজবপুর, পশ্চিমে আছে গোপালগড়—পাখির কি আর অভাব আছে?’
‘এই জানোয়ারকে কেউ দেখেনি কখনো?’
‘না। সে গুহা থেকে বেরোয় না। আমি নিজে তীর-ধনুক নিয়ে গুহার মুখে অপেক্ষা করেছি, আমার সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্য ছিল পঞ্চাশজন। কিন্তু সে দেখা দেয়নি। গুহাটা অনেক গভীর; মশাল নিয়ে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়েও তার দেখা পাইনি।’
সুজন এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনো শোনেনি। শুধু পাখি খায় এমন রাক্ষসও থাকতে পারে? আর তাকে কোনোমতেই সায়েস্তা করা যায় না, এত বড় আজব কথা!
ততক্ষণে রাজার দল প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। রাজা বলল, ‘প্রাসাদের এক তলায় একটা ঘরে তুই থাকবি। কাল সকালে আমার মেয়েকে একবার শোনাবি তোর পাখি আর জানোয়ারের ডাক। আমার মেয়ের নাম শ্রীমতী। তার মতো বিদুষী মেয়ে আর ভূভারতে নেই। সে শাস্ত্র পড়েছে, ব্যাকরণ পড়েছে, ইতিহাস পড়েছে, গণিত পড়েছে, দেশবিদেশের রূপকথা সে জানে, রামায়ণ মহাভারত জানে। সে ঘরেই থেকেছে চিরটা কাল। সূর্যের আলো তার গায়ে লাগতে দিইনি, তাই তার মতো দুধে-আলতায় রং আর কোনো মেয়ের নেই!’
সুজন ত শুনে অবাক। মেয়েমানুষের এত বিদ্যেবুদ্ধি? আর সে নিজে যে অবিদ্যের জাহাজ! এই রাজকন্যার সঙ্গে ত কথাই বলা যাবে না।
‘এই রাজকন্যারই কি বিয়ে হবে?’ সে জিগ্যেস করল রাজাকে।
‘হ্যাঁ, এরই বিয়ে। আজবপুরের যুবরাজের সঙ্গে। সেও পণ্ডিত ছেলে, অনেক পড়াশুনো করেছে। রূপেগুণে সব দিক দিয়েই ভালো।’
রাজপ্রাসাদে পৌঁছে সুজনকে তার ঘর দেখিয়ে দিল রাজার একজন পরিচালক। রাজামশাই বললেন, ‘আজ বিশ্রাম কর, কাল সকালে তোকে এরা নিয়ে আসবে আমার কাছে। তারপর তোর গুণের পরীক্ষা হবে।’
‘একটা কথা রাজামশাই।’ সুজন ওই পাখিখোর রাক্ষসের কথা তুলতেই পারছিল না।
‘কী কথা?’
‘আকাশী পাহাড়টা এখান থেকে কত দূরে?’
‘চার ক্রোশ পথ। কেন?’
‘না, এমনি জিগ্যেস করছিলাম।’
রাজা যে তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন সেটা সুজন তার ঘর দেখেই বুঝতে পারল। দিব্যি বড় ঘর, তাতে চমৎকার নকসা করা একটা পালঙ্ক, আর তাছাড়াও আসবাব রয়েছে কাঠের আর শ্বেতপাথরের। পালঙ্কের বালিশের মতো বাহারের নরম বালিশ সুজন কখনো চোখেই দেখেনি, ব্যবহার করা তো দূরের কথা।
রাত্তিরে খাবারও এলো এমন যা সুজন কোনোদিন খায়নি। কতো পদ, আর তাদের কী স্বাদ, কী গন্ধ! সব শেষে মিষ্টান্নই এল পাঁচ রকম। এত খাবে সে কী করে?
যতটা পারে তৃপ্তি করে খেয়ে সুজন ভাবতে বসল। সেই রাক্ষসের কথাটাই বার বার মনে পড়ছে তার। পাখির মতো এত সুন্দর জিনিস, আর সেই পাখিই এই রাক্ষস টপ্ টপ্ করে গিলে খায়? এমনই তার খিদে যে শহরের সব পাখি সে শেষ করে ফেলেছে। একবার তার আস্তানাটা দেখে এলে হয় না? সুজনের এখনো ঘুম পায়নি। বাইরে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড় কোন দিকে সে তো দেখাই আছে, শুধু গুহাটা কোথায় সেটা খুঁজে বার করা।
সুজন খাট থেকে উঠে পড়ল। তারপর দুগ্গা বলে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। তাকে সকলেই চিনে গেছে, কাজেই ফটকে কেউ কিছু জিগ্যেস করল না।
চারিদিকে ফুটফুটে চাঁদের আলো, সুজন তারই মধ্যে সটান চলল আকাশী পাহাড় লক্ষ করে। অল্প কুয়াশায় পাহাড়টাকে মনে হয় ঝাপসা।
নিঝুম শহর দিয়ে দেড় ঘণ্টা হেঁটে সুজন গিয়ে পৌঁছল পাহাড়ের তলায়। চারদিকে জন-মানব নেই, রাতের প্যাঁচাও বোধহয় গেছে রাক্ষসের পেটে।
পাহাড়ের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকটা পৌঁছাতেই সুজন দেখতে পেল মাটি থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাত উপরে একটা অন্ধকার গুহা।
এটাই নিশ্চয় সেই রাক্ষসের গুহা। মানুষও কি এই রাক্ষসের খাদ্য নাকি? আশা করি নয়।
সুজন সাহস করে পাহাড় বেয়ে উঠে গেল।
এই যে গুহার মুখ। পাহাড়ের উল্টো দিকে চাঁদ, তাই গুহার ভিতরে মিশকালো অন্ধকার।
সুজনের মনে রাগ থেকে কেমন যেন একটা সাহস এসেছে। পাখিরা তার বন্ধু; আর সেই বন্ধুরা যাচ্ছে এই রাক্ষসের পেটে, তাই এ রাগ।
সুজন অন্ধকার গুহার ভিতরটায় গিয়ে ঢুকল।
দশ পা ভিতরে যেতেই তাকে সেই দশ পা-ই ছিট্কে বেরিয়ে আসতে হল।
গুহার ভিতর থেকে একটা ভয়ংকর হুঙ্কার শোনা গেছে। এমন বীভৎস ডাক কোনো জানোয়ারের মুখ দিয়ে বেরোয় না।
এটা রাক্ষস, আর রাক্ষস সুজনকে দেখেছে, আর দেখে মোটেই পছন্দ করেনি।