সাড়ে তিন হাত জমি – মূল: লেব তলস্তয় / রূপান্তর : প্রফেসর ড. সরকার আবদুল মান্নান
পাখোমের স্বপ্ন
পাখোম শুয়েছিল পাখির পালকের বিছানায়। খুব আরামদায়ক। কিন্তু তবুও তার ঘুম হয়নি। অনেক জমির মালিক হতে যাচ্ছে সে। ২০,০০০ একর তো বটেই। চিন্তায় উত্তেজনায় সারা রাত সে ঘুমোতে পারল না। কিন্তু ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ল। একটা স্বপ্নও দেখল। বাইরে যেন কার হাসির শব্দ। স্বপ্নেই সে বেরিয়ে গেল। দেখল স্টার্শিনা। একটু এগিয়ে দেখল লোকটি স্টার্শিনা নয়, সেই মহাজন। এই লোকটিই তাকে এখানে আসতে বলেছিল। কিছু জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি যেন বদলে গেল। এখন সে ভলগার ভাটি থেকে আসা সেই চাষি। সব শেষে পাখোম দেখল, এ হচ্ছে একটি শয়তান; মাথায় শিং, পায়ে খুর। বিকট শব্দ করে সে হাসছে। অদূরে একটি লোক পড়ে আছে। তার মুখ কাগজের মতো সাদা। লোকটির দিকে তাকিয়ে পাখোম দেখল, লোকটি সে নিজে। তার দম যেন আটকে এল। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেল ঘুম। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। এখনই সূর্য উঠবে। তাকেও জমি-দখলের দৌড় শুরু করতে হবে।
পাখোমের প্রয়োজনীয় জমি
শিকান নামে একটি গোল পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর স্টার্শিনা তার টুপি রাখল। টুপির মধ্যে পাখোমের ১০০ রুবল। এখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। পাখোম দেখল সবই উর্বর জমি, সোনার টুকরো। অনেক চিন্তা করে সে সূর্য-উদয়ের দিকে যাত্রা করল। আস্তেও নয়, খুব জোরেও নয়। ১১৬৬ গজ যাবার পর সে একটু থামল। একটি খুঁটি পুতল। এখন সে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে লাগল। থেমে আর একটি খুঁটি পুতে দিল। সূর্যের দিকে তাকাল একবার। গোল পাহাড়টার ওপর আলো পড়েছে। পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপরও আলো পড়েছে। হিসাব করে দেখল, প্রায় সাড়ে তিন মাইল পথ হাঁটা হয়েছে। আরও সাড়ে তিন মাইল হেঁটে সে বাঁ-দিকে মোড় নেবে। শরীর তার গরম হয়ে উঠেছে। কোট খুলে ফেলল, জুতাও। হাঁটতে তার খুব ভালো লাগছিল। তাই ভালো ভালো জমি দেখে বাঁক- মোড় নিতে লাগল।
গোল পাহাড়টা এখন আর দেখা যায় না। পাখোম ভাবল : মোড়টা বেশ বড় হয়েছে নিশ্চয়। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। সে ক্লান্ত বোধ করছে। সে খানিকটা পানি খেল। একটি খুঁটিও পোতা হলো। পথে বড় বড় ঘাস। ভ্যাপসা গরম। তার ভিতর দিয়ে সে ছুটতে লাগল।
ঠিক দুপুরে সে সামান্য রুটি খেল। দাঁড়িয়ে সামান্য জিরিয়েও নিল। মাটিতে সে বসল না। কারণ বসলে শুতে ইচ্ছে হবে, আর শুলে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। রুটি খাওয়ার পর হাঁটতে সুবিধা হলো। কিন্তু সামান্য পরেই তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। কিন্তু শরীরকে আসকারা দিলে চলে না। কেননা সামান্য কষ্টেই তার অনেক লাভ।
সাড়ে ছয় মাইল পথ সে পেরিয়েছে। তার পরও কিছু উর্বর জমি ছেড়ে আসতে পারেনি। কী করে ছাড়ে। চমৎকার তিসি হবে এ জমিগুলোতে। গোল পাহাড় থেকে ১০ মাইল পথ দূরে এসেছে সে। আর পশ্চিম আকশে সূর্য অনেকটা হেলে গিয়েছে। অথচ সে ফিরতে পেরেছে ১ মাইলের চেয়ে সামান্য বেশি। এখন সে আর কোনো বাঁক নিচ্ছে না। সোজাসুজি হেঁটেও সে যেন এগুতে পারছে না। জুতা সে খুলে ফেলেছিল অনেক আগেই। এখন খালি পা কেটে ছিঁড়ে গিয়েছে। হাঁটতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। শরীর কাঁপছে। পা কাঁপছে। একটু বিশ্রামের বদলে সে সব কিছু দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম করলে চলবে না। তাই কে যেন চাবুক মেরে মেরে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কত পথ বাকি। অথচ সে মৃত প্রায়। এত পথ সে পেরিয়ে এসছে। কী করে তা ফিরে যাবে।
কিন্তু ফিরতে তাকে হবেই। সব অর্থ, সব পরিশ্রম বৃথা যেতে পারে না। পা ফেটে রক্ত ঝরছে। তবুও সে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। তবুও যেন এগুতে পারছে না। কোট, জুতা, ফ্লাস্ক, টুপি সব ছুড়ে ফেলে দিল। তবুও দৌড়াতে তার দারুণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর কে যেন হাপর টানছে। হৃৎপিন্ডের ভিতরে মারছে হাতুড়ি। পা দুটি দেহের ভার সইছে না, ভেঙে পড়ছে।
জমির কথা সে ভুলে গেল। নিজেকে বাঁচানোই এখন একমাত্র চিন্তা। সূর্য এখন অস্ত যাওয়ার পথে। গোল পাহাড়ের লোকগুলো তাকে ডাকছে। চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। সে শেয়ালের চামড়ার টুপিটি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল। তার ভিতরে টাকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে স্টার্শিনা। তার স্বপ্নের কথা মনে হলো। তবুও সে পৌঁছাতে চায়। নিজেকে সে খুন করেছে। তুবুও দৌড় বন্ধ করল না। সূর্য যখন অস্ত গেল তখন সে পাহাড় ছুঁয়েছে। একটি মুমূর্ষু জন্তুর মতো সে পাহাড় ডিঙিয়ে টুপিটি স্পর্শ করল। স্পর্শ করতে করতে সে নিচে পড়ে গেল। স্টার্শিনা চিৎকার করে উঠল, ‘হায় যুবক, অনেক জমি তুমি পেলে বটে।’ পাখোমের মজুর ছুটে গেল তার কাছে। তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল। তখন তার মুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইছে।
পাখোম মারা গেল। স্টার্শিনা হাসতে লাগল। শেষে সাড়ে তিন হাত জমির মধ্যে পাখোমের সমাধি হলো।