রামের সুমতি – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

চার

রাম ভাত খাইতে বসিয়াছিল। দিগম্বরী আড়ালে বসিয়া সুর তুলিয়া বলিলেন, অত বড় ছেলেকে অমন করে মারা কেন? ওর বড়ভাই কোনদিন গায়ে হাত তোলে না।

নেত্য কাজ করিতে করিতে বলিল, তুমি কম নও, দিদিমা! তুমিই ত ও-সব কথা মাকে এসে লাগাও।

সে রাত্রে অত মার তাহার মোটেই ভাল লাগে নাই; রাম শুনিয়া চোখ পাকাইয়া বলিল, ডাইনী বুড়ী আমাদের সব খেতে এসেছে!

দিগম্বরী চেঁচাইয়া উঠিলেন, নারাণি, শুনে যা তোর দেওরের কথা।

নারায়ণী স্নান করিতে যাইতেছিলেন, ফিরিয়া আসিয়া ক্লান্তভাবে বলিলেন, পারিনে মা, আর কথা শুনতে; সত্যি বলচি নেত্য, মরণ হলে আমার হাড় জুড়োয়—আর সহ্য হচ্ছে না। ওরে ও বাঁদর, এখনো তোর পিঠের দাগ মিলোয় নি, এর মধ্যেই সব ভুলে গেলি!

রাম জবাব দিল না, ভাত খাইতে লাগিল। নারায়ণী আর কোন কথা না বলিয়া স্নান করিতে চলিয়া গেলেন। উঠানের উপরেই একটা পিয়ারাগাছ ছিল, ভাত খাইয়া রাম তাহার উপর উঠিল এবং নির্বিচারে কাঁচা-পাকা পিয়ারা চর্বণ করিতে লাগিল। কোনটার কতকটা খাইল, কোনটার একটু কামড়াইয়াই ফেলিয়া দিল। নিতান্ত কাঁচাগুলা নিরর্থক ছিঁড়িয়া এদিকে-ওদিকে ছুঁড়িয়া ফেলিতে লাগিল। দেখিয়া দিগম্বরীর গা জ্বালা করিতে লাগিল। নারায়ণী বাড়িতে নাই, তিনি আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলেন, তোমার জন্য ত বাছা, পাকা পিয়ারা দাঁতে কাটবার জো নেই, কাঁচাগুলো নষ্ট করে কি হচ্ছে?

রাম কোনদিনই তাঁহার কথা সহিতে পারিত না। বিশেষ, এইমাত্র নেত্যর কাছে মার খাইবার কারণ জানিতে পারিয়া, রাগে ফুলিতেছিল, গাছের উপর হইতে চেঁচাইয়া বলিল, বেশ করচি—বুড়ী!

এই বিশেষণটা দিগম্বরী সবচেয়ে অপছন্দ করিতেন, মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন, বুড়ী! বেশ কচ্চ? আচ্ছা, আসুক সে। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর হওয়া চাই ত! কি বেহায়া ছেলে বাবা!—মার খেয়ে পিঠের চামড়া উঠে গেল, তবু লজ্জা হ’ল না!

রাম উপর হইতে বলিল, ডাইনী বুড়ী!

ডাইনী বুড়ী! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! পাজী হারামজাদা, নাব বলচি।

রাম বলিল, নাবব কেন? তোমার বাবার গাছ?

দিগম্বরী ক্ষেপিয়া উঠিলেন, চীৎকার করিয়া বলিলেন, অ্যাঁ—বাপ তুললি? শুনলি নেত্য, শুনলি?

ঠিক এই সময় নারায়ণী ঘাট হইতে আসিয়া পড়িলেন। গাছের উপর দৃষ্টি পড়িতেই বলিলেন, ভাত খেয়ে ইস্কুলে গেলিনে? গাছে চড়েছিস যে!

রাম ভাবিয়া রাখিয়াছিল, গাছের উপর হইতে দূরে বৌদিকে আসিতে দেখিয়াই সে নামিয়া পলাইবে। কিন্তু ঝগড়ায় ব্যস্ত থাকায় পথের দিকে নজর করে নাই। বৌদিদি একেবারে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। সে ভয়ে বলিল, পিয়ারা খাচ্চি।

তা ত খাচ্চিস—ইস্কুলে গেলিনে?

আমার পেট কামড়াচ্চে যে!

নারায়ণী জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, তাই ভাত খেয়ে উঠে কাঁচা পিয়ারা চিবোচ্চ?

দিগম্বরী মেয়ের গলা শুনিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন,—হারামজাদা ছোঁড়া আমার বাপ তোলে! বলে, নাবব কেন—তোমার বাপের গাছ?

নারায়ণী চোখ তুলিয়া বলিলেন, বলেছিস?

রাম চোখ-মুখ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, না বৌদি, বলিনি।

দিগম্বরী চেঁচাইয়া উঠিলেন, বলিস নি হারামজাদা! নেত্য সাক্ষী আছে। তার পর মুখ বিকৃত করিয়া সানুনাসিক সুর করিয়া বলিতে লাগিলেন, সেদিন যখন বেতের উপর বেত পড়েছিল, তখন—আর করব না বৌদি—পায়ে পড়ি বৌদি—মরে গেলুম বৌদি,—চেপে ধরলে চিঁচিঁ কর, আর ছেড়ে দিলে লাফ মার, হারামজাদা!

রাম আর সহ্য করিতে পারিল না। তাহার হাতে একটা বড় কাঁচা পিয়ারা ছিল—ধাঁ করিয়া ছুঁড়িয়া মারিয়া দিল। সেটা দিগম্বরীকে স্পর্শ করিল না, নারায়ণীর ডান ভ্রূর উপরে গিয়া সজোরে আঘাত করিল। এক মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখিয়া তিনি সেইখানেই বসিয়া পড়িলেন। দিগম্বরী ভয়ঙ্কর চেঁচামেচি করিয়া উঠিলেন, নেত্য কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিল, রাম গাছ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারিল।

দুপুরবেলা শ্যামলাল স্নানাহার করিতে আসিয়া দেখিলেন বিষম কাণ্ড! নারায়ণী নির্জীবের মত বিছানায় পড়িয়া আছেন, তাঁহার ডান চোখ ফুলিয়া ঢাকিয়া গিয়াছে। তাহার উপর ভিজা ন্যাকড়ার পটি বাঁধিয়া নেত্য পাখা লইয়া বাতাস করিতেছে। দিগম্বরী আজ আর আড়ালে গেলেন না, সামনেই চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, রাম মেরে ফেলেচে নারাণীকে।

শ্যামলাল চমকাইয়া উঠিলেন। কাছে আসিয়া আঘাত পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া কঠিনভাবে স্ত্রীকে বলিলেন, আজ তোমাকে আমি দিব্যি দিচ্ছি—যদি ওকে খেতে দাও, যদি কোনদিন কথা কও—যদি কোন কথায় থাক, সেই দিনে যেন তুমি আমার মাথা খাও।

নারায়ণী শিহরিয়া উঠিয়া বলিলেন, চুপ কর, চুপ কর—ও-কথা মুখে এনো না।

শ্যামলাল বলিলেন, আমার এত বড় দিব্যি যদি না মানো, সেই দিনে যেন তোমাকে আমার মরা-মুখ দেখতে হয়। বলিয়া ডাক্তার ডাকিয়া আনিতে নিজেই চলিয়া গেলেন।

সমস্ত দিন নদীর ধারে ধারে বেড়াইয়া, বসিয়া, দাঁড়াইয়া, অসম্ভব কল্পনা করিয়া রাম সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকাইয়া বাড়ি ঢুকিল। দেখিল, উঠানের মাঝামাঝি ছ্যাঁচা বাঁশের বেড়া দিয়া বাড়িটিকে দুই ভাগ করা হইয়াছে। নাড়া দিয়া দেখিল, বেশ শক্ত, ভাঙ্গা যায় না। রান্নাঘরে আলো জ্বলিতেছিল, চুপি চুপি মুখ বাড়াইয়া দেখিল, সেখানেও ওই ব্যবস্থা করা হইয়াছে। ঘরে কেহ নাই, শুধু একরাশ পিতল-কাঁসার বাসন মেজের উপর পড়িয়া আছে। ব্যপারটা যে কি, তাহা ঠিক না বুঝিতে পারিলেও, সকালবেলার কাণ্ডটার সহিত কেমন করিয়া যেন যোগ রহিয়াছে, তাহা অনুমান করিয়া তাহার বুক শুকাইয়া উঠিল। তখন ফিরিয়া গিয়া সে চুপ করিয়া তাহার নিজের ঘরের মধ্যে বসিয়া বাটীর অপর খণ্ডের গতিবিধি শব্দসাড়া শুনিতে লাগিল। ইতিপূর্বে তাহার যে অত্যন্ত ক্ষুধা বোধ হইয়াছিল, এখন সে কথাও ভুলিয়া গেল। রাত্রি তখন বোধ করি নয়টা, সে ঘুরিয়া গিয়া খিড়কির দরজায় ঘা দিতেই নেত্য কপাট খুলিয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। রাম জিজ্ঞাসা করিল, বৌদি কোথায় নেত্য?

ঘরে শুয়ে আছেন।

রাম ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, বৌদি খাটের উপর শুইয়া আছেন, এবং নীচে মাদুর পাতিয়া দিগম্বরী ছোট মেয়েটিকে লইয়া বসিয়া আছেন। গোবিন্দ খেলা করিতেছিল, ছুটিয়া আসিয়া কাকার হাত ধরিয়া ঝুলিতে ঝুলিতে বলিয়া দিল, কাকা, তোমার বাড়ি ওদিকে, এদিকে আমাদের বাড়ি। বাবা বলেচে, তুমি এ-ঘরে ঢুকলে পা ভেঙ্গে দেবে।

রাম খাটের উপর নারায়ণীর পায়ের কাছে গিয়া বসিতেই তিনি পা সরাইয়া লইলেন। রাম চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। দিগম্বরী তাঁহার ছোট মেয়েকে ঠেলা দিয়া বলিলেন, সুরো, বল না তোর দাদাবাবু কি বলেচে ওকে।

সুরধুনী মুখস্থর মত গড়গড় করিয়া বলিয়া গেল—দাদাবাবু বলেচে, তুমি এখানে এসো না। কাল সকালে সব—কি মা?

দিগম্বরী বলিলেন, বিষয়-সম্পত্তি।

সুরধুনী বলিল, বিষয়-সম্পত্তি কাল ভাগ-বাটরা করে দেবে।

দিগম্বরী বলিলেন, দিব্যি দেবার কথাটা বল্‌ না—ন্যাকা মেয়ে!

সুরধুনী বলিল, দাদাবাবু দিব্যি দিয়েচেন দিদিকে,—খেতেও দেবে না, কথাও বলবে না—বললে দাদাবাবু—। নারায়ণী বিছানার উপর হইতে ধমক দিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, হয়েচে হয়েচে, তুই চুপ কর্‌।

তখন দিগম্বরী বলিলেন, তা সত্যি বাছা! তুমি মানুষ-জনকে আধ-খুন করে ফেলবে—সে দিব্যি না দিয়ে আর করে কি! আমি ত বাপু, কিছুতে তার দোষ দিতে পারব না—তা যে যাই বলুক! এ বাড়িতে তোমার আসা-যাওয়া খাওয়া-দাওয়া আর চলবে না। ওকে সোয়ামীর মাথার দিব্যিটা ত মানতে হবে?

সুরধুনী বলিল, মা, ভাত দেবে চল না।

দিগম্বরী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, সবুর কর বাছা।

রাম তখনও বসিয়া আছে; এমন অবস্থায় ঘরে-দোরে আগুন ধরিয়া গেলেও ত তিনি উঠিতে পারেন না। রামের বুকের ভিতর চাপা কান্না মাথা খুঁড়িতে লাগিল, কিন্তু দিগম্বরীর সেই সকালবেলার খোনা কথার ভ্যাংচানি তাহার বুকের উপর পাথর চাপাইয়া পথ আটকাইয়া রাখিল। একবার সে কাঁদিতে পারিল না, একবার বলিতে পারিল না, ‘আর করব না বৌদি!’ এই একটা কথা অনেক আপদে-বিপদেই তাহাকে রক্ষা করিয়াছে—আজ তাহাই বলিতে না পাইয়া তাহার দম আটকাইয়া আসিতে লাগিল।

এমন সময়ে নারায়ণী ক্লান্তভাবে বলিলেন, সুরো, যেতে বল্‌ ওকে।

এবার সে কান্না চাপিয়া বলিয়া উঠিল,—যেতে বল্‌ ওকে! আমার খিদে পায় না বুঝি! সেই ত কখন খেয়েচি!

নারায়ণী একটু উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, একেবারে খুন করে ফেলতে পারেনি? তা হলে দশহাতে খেতো! আমি জানিনে—যাক ও নেত্যর কাছে।

যাব না নেত্যর কাছে। আমি কারো কাছে যাব না—আমি না খেয়ে উপোস করে শুয়ে থাকব। বলিতে বলিতে রাম দুমদুম করিয়া পা ফেলিয়া বাড়িঘর কাঁপাইয়া নিজের ঘরে গিয়া শুইল। নেত্য কিছু খাবার আনিয়া বলিল, ছোটবাবু ওঠ, খাও।

রাম লাফাইয়া গর্জন করিয়া উঠিল, দূর হ, পোড়ারমুখী—দূর হ!

নেত্য খাবার রাখিয়া চলিয়া গেল, রাম থালা-গেলাস ঝনঝন করিয়া উঠানের উপর ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।

সকালবেলা শ্যামলাল কাজে চলিয়া যাইবার পরে, রাম নিজের উঠানে পায়চারি করিতে করিতে গর্জাইতে লাগিল—আমি দিব্যি মানিনে! ওঃ ভারী দিব্যি! ও কে যে, দিব্যি দেয়? ও কি আমার আপনার দাদা? ও কেউ নয়, ওর কথা আমি মানিনে। আমি কি ওকে মেরেচি? বুড়ী ডাইনীকে মেরেছি। ও ত শুধু বৌদিকে লেগেছে, তবে ওরা কেন দিব্যি দিতে আসে!

এ-সকল কথার কেহই জবাব দিল না, খানিক পরে সে সুর বদলাইয়া বলিতে লাগিল—বেশ ত! ভালই ত! না-ই কথা কইলে, না-ই খেতে দিলে! আমি মজা করে রাঁধব—ভাত, ডাল, ভাল ভাল তরকারি, মাছ—একলা বেশ পেট ভরে খাব। আমার কি হবে?

এ কথারও কেহ জবাব দিল না। তখন সে রান্নাঘরে ঢুকিয়া খনখন ঝনঝন শব্দে থালা, ঘটি, বাটি নাড়িয়া চাড়িয়া কাজ করিতে লাগিল। হাঁক-ডাক করিয়া ভোলাকে চাল-ডাল ধুইয়া আনিতে, তরকারি কুটিতে আদেশ দিল। সমস্তই নেত্য রান্নাঘরে রাখিয়া গিয়াছিল। ভোলাকে হুকুম করিল, তুই আমার চাকর, ও-বাড়ি যাস্‌নে। ও-বাড়ির কেউ যদি এদিকে আসে, তার পা ভেঙ্গে দিবি—বুঝলি ভোলা, নেত্য আসুক একবার এদিকে।

নারায়ণী রান্নাঘরের বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়া শুনিতে লাগিলেন। দিগম্বরী কৌতূহলী হইয়া মাঝে মাঝে বেড়ার ফাঁক দিয়া দেখিতেছিলেন। খানিক পরে বড় মেয়ের কাছ উঠিয়া আসিয়া হাসি চাপিয়া ফিসফিস করিয়া বলিতে লাগিলেন, আহা, বাছার কি বুদ্ধি! উনি আবার ভাল তরকারি রেঁধে খাবেন! একটা পেতলের হাঁড়িতে প্রায় এক কাঠা চাল গলায় গলায় তুলে দিয়ে রান্না চড়িয়েচে—তাতে জল দিয়েচে এক ফোঁটা। একজন খাবে ত, রাঁধছে দশজনের, তাই বা সেদ্ধ হবে কি করে? পুড়ে আঙরা উঠবে যে! ঐ হাঁড়িতে কি অত চাল ধরে, না, ঐটুকু জলের কর্ম! আবার রাঁধিয়ে বলে দেমাক আছে! রাঁধি বটে আমরা, কিন্তু দেমাক কত্তে জানিনে! ভাত রাঁধব, তা এমন জল দেব, আর দেখতে হবে না—চোখ বুজে সেদ্ধ হবে! কৈ রাঁধুক দিকি আমার সঙ্গে! লোকে খেয়ে কারটা ভাল বলে দেখি!

নারায়ণী মুখ ফিরাইয়া রহিলেন।

নেত্য কাছে ছিল, সে বলিল, দিদিমার এক কথা। ও কি কোনদিন এক ঘটি জল গড়িয়ে খেয়েছে যে, আজ রেঁধে খাবে?

সে অনেক দিনের দাসী, এ-সব ব্যাপার তাহার ভাল লাগিতেছিল না।

মায়ের দেখাদেখি সুরধুনীও মাঝে মাঝে গিয়া বেড়ার ফাঁক দিয়া দেখিতেছিল। ঘণ্টাখানেক পরে ছুটিয়া আসিয়া দিদির হাত ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল—ও দিদি, দেখবে এস—রামদাদা—মা গো! একেবারে কাঁচা ভাতগুলো শুধু খাচ্চে। কিচ্ছু নেই দিদি—একেবারে শুধু ভাত, আচ্ছা দিদি, কাঁচা ভাতে পেট কামড়াবে না?

নারায়ণী তাহার হাত ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া গিয়া বিছানার উপর শুইয়া পড়িলেন। সে যে কত দুঃখে, কত বড় ক্ষুধার তাড়নে এইগুলা খাইতে বসিয়াছে, সে কথা তাঁহার অগোচর রহিল না।

দুপুরবেলা শ্যামলালের খাওয়া হইয়া গেলে, দিগম্বরী ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন, যা পারিস, দুটি খেয়ে নে নারাণি! ওর তাড়সে জ্বরের মত হয়েচে,—ওতে খাওয়া চলে। আমি বলচি, ক্ষেতি হবে না।

নারায়ণী মোটা চাদরটা আগাগোড়া মুড়ি দিয়া ভাল করিয়া শুইয়া বলিলেন, আমাকে বিরক্ত ক’র না মা, তোমরা খাও গে।

দিগম্বরী বলিলেন, ভাত না খাস, দু’খানা রুটি ক’রে দি—না হয়—

নারায়ণী কহিলেন, না, কিচ্ছু না।

দিগম্বরী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ও আবার কি কথা? কাল থেকে উপোস করে আছিস, আজ দুটি না খেলে হবে কেন?

নারায়ণী জবাব দিলেন না। নেত্য আসিয়া বলিল, তুমি মিথ্যে বকে মরচ দিদিমা। ঐখানে দাঁড়িয়ে একবেলা চেঁচালেও ওঁকে খাওয়াতে পারবে না। জ্বর হয়েছে, একটু ঘুমোতে দাও।

দিগম্বরী চলিয়া গেলেন, বলিতে বলিতে গেলেন, জানিনে বাপু, নাগ্‌লে-টাগ্‌লে একটু জ্বরভাব হয়, তাই বলে কি মানুষ উপোস করে পড়ে থাকে? আমরা ত পারিনে।

বৈকালে নারায়ণী আবার রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়া বসিলেন, এবং যতবার নেত্যর চোখে চোখে হইল, ততবারই কি কথা বলিতে গিয়া যেন চাপিয়া গেলেন।

রাম স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া হাতমুখ ধুইয়া দোকান হইতে মুড়ি-মুড়কি কিনিয়া আনিল। খাইতে খাইতে গলা বড় করিয়া বলিল, কি আর ক্ষেতি হ’ল আমার? ভাত খেয়ে ইস্কুলে গেলুম, আবার ফিরে এসে কেমন খাচ্চি।

বেড়ার ওদিকে সকলেই রহিয়াছে, তাহা সে বুঝিল, কিন্তু সকালের মত এখনও কেহ জবাব দেয় না দেখিয়া সে আরও অস্থির হইয়া উঠিল। চেঁচাইয়া বলিল, এই দিকটা আমার সীমানা। কোনদিন নেত্য কি কেউ যদি আমার সীমানায় আসে, তখন পা ভেঙ্গে দেব।

এই পা-ভাঙ্গার ভয় সে ইতিপূর্বেও দেখাইয়াছিল, সেবারেও যেমন ফল হয় নাই, এবারেও হইল না। কেহ ভয় পাইয়াছে কিনা, বোঝা গেল না। সন্ধ্যার পর আলো জ্বালিয়া সে রান্নাঘরে ঢুকিয়া আবার চেঁচামেচি করিতে লাগিল, আমার কাঠ কৈ, আমি রাঁধব কি দিয়ে? আমার শিলনোড়া কৈ, আমি বাটনা বাটব কিসে? ও-ঘর হইতে নেত্য বলিল, মা বলেচেন, কাল শিলনোড়া কিনে দেবেন।

না, আমি কেনা শিলনোড়া চাইনে। বলিয়া সে কাঁদিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কেন আমার গণেশকে ধরালে? কেন, আমাকে খোনা খোনা করে ও বুড়ী ভেঙালে, বেশ করেচি গাল দিয়েচি—ও মরে আর জন্মে পেত্নী হবে।

দিগম্বরী চোখ কটমট করিয়া বলিলেন, শুনলি নারাণি, শুনলি! এ-সমস্ত পায়ে পা তুলে দিয়ে ঝগড়া করা নয়?

নারায়ণী চুপ করিয়া অন্য দিকে চাহিয়া ছিলেন, সেই দিকেই চাহিয়া রহিলেন।

পোস্টটি শেয়ার করুন