রাজা – এস. ওয়াজেদ আলি

রাজা
– এস. ওয়াজেদ আলি

তখন আমি ছেলে মানুষ, বয়স সাত বৎসর। হঠাৎ পায়রা পোষবার শখ মাথায় চাপল। কাঠের বাক্সের একটি খোপ বানিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে দিলুম,আর তিন- চার জোড়া পায়রা এনে সেখনে বসিয়ে দিলুম।

তাদের আদর যত্নের অন্ত রইল না। এই পায়রার নেশা যখন উগ্রভাবে মাথায় বর্তমান, সেই সময়ে এক দিন নানিজানের এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলুম। তাদের অনেক পায়রা ছিল। সেগুলি খেলছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের দেখতে লাগলুম। তাদের মধ্যে একটি কপোত আমার মনকে দখল করে বসল। তার গায়ের রং ছিল স্লেট পাথরের মত ধূসর। গলায় নীল রঙের পালকগুলি সূর্যের আলোয় চকমক করছিল। সে তার মাথায় উঁচু টোপরটি স্বগর্বে নেড়ে, ‘বাক বাকুম’ ‘বাক বাকুম’ করতে করতে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছিল, আর অন্য কপোত কপোতীরা সম্ভ্রমে তার জন্য পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। তার আকার ছিল অন্য পায়রার তুলনায় অনেক বড়। আমি স্বভাবতই তাকে দলের নেতা বলে মনে করলুম। ‘রাজা’ বলে ডাকতে ডাকতে তার কাছে গেলুম। সে আমাকে দেখে পালাবার চেষ্টা করল না, আগের মতই স্বগর্বে ‘বাক বাকুম’ করে বেড়াতে লাগল।

রাজাকে নিজের সম্পত্তিতে পরিণত করবার এক দুর্নিবার লোভ আমার মনকে পেয়ে বসল। ছেলেবেলার আগ্রহ কোন বাধা বিপত্তি মানে না। আমি তৎক্ষণাৎ নানিজানের কাছে গিয়ে আবদার ধরে বসলুম। পরের জিনিস লোভ করতে নেই, এই কিন্তু বোঝবার ছেলেই ছিলাম না। আমাদের আত্মীয়েরা আমার আবদারের কারণ জানতে পেরে বললেন, ‘তা নিয়ে যাও বাবা। তোমার যখন পছন্দ হয়েছে তখন আর কী করা যায়। ও পায়রাটি আর ওর জুড়িকে তোমায় বকশিশ দিলুম।’ নানিজানের আপত্তি সত্ত্বেও আমি তখন ‘রাজা’ আর ‘রানি’ কে নিয়ে স্বগর্বে বাড়ি এলুম। তাছাড়া তারা যাতে তাদের পুরানো আবাসে ফিরে যেতে না পারে, সেই উদ্দেশে কাঁচি দিয়ে তাদের পালক কেটে দিলুম।

রাজা যেমন তার পুরানো রাজ্যে স্বচ্ছন্দে রাজত্ব করত আমাদের বাড়িতে আমার পায়রাগুলির মধ্যেও ঠিক সেইরূপ স্বচ্ছন্দে রাজত্ব করতে লাগল। তার এই নতুন আবাসে তাকে দেখলে মনে হত রাজা হবার জন্যই সে জন্মেছে; আর তার সমসাময়িকদের পক্ষে তার প্রাধান্য স্বীকার করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।

রাজার বেশভূষার একটা বিশেষত্ব থাকা দরকার মনে করে এক দিন একটি নূপুর কিনে তার পায়ে পরিয়ে দিলুম। রাজার পায়ের সেই নুপুরের ধ্বনি বড় সুন্দর শোনাত। নূপুরটি যে তারও বিশেষ এক গর্বের জিনিস ছিল, সে তার ব্যবহার দেখেও স্পষ্ট বোঝা যেত। ‘বাক বাকুম’ ‘বাক বাকুম’ করতে করতে পায়চারি করবার সময় নূপুরটিতে বিশেষ একটি তাল দিয়ে বাজাতে রাজা কোনোমতেই ত্রুটি করত না।

সকাল হলেই রাজা আর তার অনুচরেরা ঝটপট করে তাদের খোপ থেকে বারান্দায় নেমে আসতে। আমি তখন তাদের জন্য মেঝেতে ধান ছড়িয়ে দিতুম। তারা আগ্রহের সঙ্গে খুঁটে খুঁটে সেগুলো খেত, আর আমি মুগ্ধ নয়নে তাদের দেখতুম। রাজার ভোজনটা অবশ্য রাজার মতই হত। আহার সাঙ্গ করে রাজা ‘বাক বাকুম’ ‘বাক বাকুম’ করতে করতে তার অনুচরদের দলে ঘুরে বেড়ত আর তারা ব্যস্ত-ত্রস্তভাবে তার পথ ছেড়ে দিত। কোনো কপোতকে কোনো কপোতীর ওপর অত্যাচার করতে দেখলে কিংবা প্রবল কপোতকে দুর্বল কপোতের ওপর জুলুম জবরদস্তি করতে দেখলে রাজা তাদের শাস্তি বিধানে কিছুমাত্র ইতস্তত করত না। সে তার তীক্ষ্ম ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাতে ঠোঁকরাতে সেই অপরাধী পায়রাদের একবারে নাজেহাল করে দিত। সে বেচারিরা তখন পালিয়ে আসবার সময় দণ্ডিত অপরাধীর মত চুপ করে বসে থাকত; আর রাজা ঘন ঘন মাথা নেড়ে স্বরোষে মেঝের ওপর দ্রুত পদসঞ্চালন করে বেড়াত।

আমার সঙ্গে রাজার সৌহার্দ্য অল্প দিনের মধ্যেই বেশ জমে উঠল। আমি রাজা বলে ডাকলে সে স্বগর্বে তার মুকুট নাড়তে নাড়তে আমার কাছে চলে আসত। আমি কখনও তাকে হাতে বসাতুম, কখনও কাঁধে বসাতুম, আবার কখনও তার সুবঙ্কিম ঠোঁটটিতে চুমো দিতুম। তখন তারা ‘কু-উ-ম’ ‘কু-উ-ম’ বলে আনন্দে গলা ফুলোতে থাকত, আমার অতরেও আনন্দের লহর বয়ে যেত।

জলযোগ শেষ করে রাজা তার দলবল নিয়ে ‘চরাট’ করতে চলে যেত। বিকেলে আমি তাদের প্রতীক্ষায় ছাদে উদগ্রীব হয়ে থাকতুম। বিকেলে আমি তাদের দেখলেই তাদের খোপের বারান্দায় গিয়ে হাজির হতুম, আর রাজাকে কোলে তুলে নিয়ে তার সংবর্ধনা করতুম। সেও আমার আদর পেয়ে গর্বে আনন্দে ফুলে উঠত।

নিয়ম মত একদিন তার দলবল নিয়ে ‘চরাট’ করতে চলে গেল। বিকেলে আমি তাদের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি- রাজার দলকে সুদূর আকাশপথে ফিরতে দেখে দৌড়ে আমি খোপের বারান্দায় গেলুম। ঝপঝপ করে পায়রারা সব নিচে নেমে বসল। আজ কিন্তু রাজাকে তাদের মধ্যে দেখতে পেলুম না। কি এক অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় আমার প্রাণ কেঁপে উঠল। আমি একান্ত ঔৎসুক্যে এদিক ওদিক চেয়ে তার অনুসন্ধান করতে লাগলুম। দৌড়ে ছাদে গিয়ে আকাশের কোণটিরদিকে চাইলুম, সেখানে তার কোনো চিহ্নই নেই। নিচে এসে আলিসার কোণে দেখলুম; খোপের ওপর দেখলুম, সেখানেও তার দেখা পেলুম না। দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে গেল, রাত হল, পায়রারা একে একে বিশ্রামে গেল; রাজার কিন্তু কোন চিহ্নই পেলুম না; তার যে বিশেষ কোনো বিপদ ঘটেছে, সে বিষয়ে তখন আমার সন্দেহ মাত্র রইলনা। কাঁদতে কাঁদতে নানিজানের কাছে গিয়ে আমার দুঃখের কথা বললুম। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- ‘আচ্ছা ভাই আর কেঁদো না। রাজার মত তোমায় আর একটা পায়রা কিনে দেব।’ আমার মন কিন্তু তাতে প্রবোধ মানল না। রাজার জন্য প্রচণ্ড উদ্বেগে আমি তারই কথা ভাবতে লাগলুম। দুই চোখ ছলছলিয়ে এল। একবার মনে হল হয়ত কোন নিষ্ঠুর শিকারির বন্দুকের গুলির ঘায়ে আমার বন্ধুর প্রাণ বিয়োগ হয়েছে। রাজা নেই একথা মনে হতে আরও দ্বিগুণ বেগে আমার চোখ দিয়ে অশ্র“ ধারা বইতে লাগলো। আবার ভাবলুম, না গুলিতে মরেনি, নিশ্চয় কোন বদমায়েশ ছেলে তাকে ফাঁদ পেতেধরেছে।

সে বেচারি আমার কাছে ফেরবার জন্যকত ছটফট করছে, আর সেই বদমায়েশ চোর আমার রাজার ছটফটানি দেখে কী ক্রূর হাসি হাসছে? নানা রকম ভাবনাচিন্তা করে শেষে স্থির করলুম, কাল সকালে রাজার জন্য এদিকে ওদিকে ভালো করে খোঁজ তল্লাশ করব। অত্যন্ত বিমর্ষচিত্তে তখন সে রাতের মত শুতে গেলাম।

পর দিন আমার যেসব পরিচিত বালকবন্ধু পায়রা পালতো তাদের বাড়ি গিয়ে রাজা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদকরলুম। কারও কাছে কিন্তু কোনো সন্তোষজনক উত্তর পেলুম না। প্রত্যহ সকালে উঠেই আমি রাজার খোপের কাছে দিয়ে দেখলুম, আর তাকে সেখানে না পেয়ে ক্ষোভে ম্রিয়মান হয়ে পড়লুম। বিকেলে যখন আমার পায়রার ঝাঁক তাদের আকাশ বিহার থেকে ফিরে আসত, আমি রাজাকে ফিরে পাবার আশায় দৌড়ে ছাদে গিয়ে তাদেরজন্য প্রতীক্ষা করতুম। তারা সকলেই ফিরত কিন্তু আমার রাজা ফিরত না। আমার পায়রারাও সাকলে যেন রাজাকে হারিয়ে শোকার্ত হয়ে পড়েছিল। রানি আলিসার এক কোণে চুপকরে বসে থাকত।

আহারের দিকে আগেকার সে আগ্রহ তার ছিল না। দলের মধ্যে নেচে হেসে ঘুরে ফিরে বেড়াবার প্রবৃত্তিও তার একেবারে চলে গিয়েছিল। সে তার রাজার অভার বিশেষভাবেই অনুভব করছিল। রাজার সহচরদের মধ্যে আগেকার সে হাসি-খেলা, নাচ-গান, ঝগড়া-কলহ একেবারে চলে গিয়েছিল। তারা নিঃশব্দে শুতে চলে যেত। কেউ যেন কোনো প্রবল জীবনী শক্তির উচ্ছল প্রবাহ থেকে তুলে হঠাৎ তাদের নিরানন্দ এবং নিরুদ্যমের রুদ্ধ সলিলে ভাসিয়ে দিয়েছে।

আমাদের গ্রামের পাশেই মোল্লা পাড়ায় রহিম নামে একটি ছেলে ছিল। বয়সে সে আমার চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড় আর দুষ্টুমিতে সে আমাদের ছেলে মহলে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল। পায়রা পোষবার ঝোঁক তারও ছিল। সে আমার পায়রা দেখতে কখনও কখনও আমাদের বাড়িতে আসত, আমি তার পায়রা দেখতে তার বাড়ি যেতুম। এ সূত্রে তার সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্টতাও হয়েছিল। রাজার সে খুব তারিফ করত, বলত এমন পায়রা দেখা যায় না।

রাজাকে হারাবার তিন চার দিন পর রহিমের ওখানে তার পায়রা দেখতে গেলুম। সে তার বাড়ির সামনে দেখছিল, রাজা হারিয়ে গেছে শুনে সে আমার প্রতি যথেষ্ঠ সহানুভূতি দেখাতে লাগল। আমাকে তার বাড়ির দিকে মুখ করতে দেখেই- ‘চল কামাল, বরজ পোতায় কুল পাড়িগে চল’ বলে সে মাঠের দিকে পা বাড়াল। কোন অদৃশ্য আকর্ষণ কিন্তু আমাকে তার বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চলল। রহিমকে অগত্যা আমার অনুসরণ করতে হল।

রহিমের পায়রাগুলি বাড়ির উঠানে চরছিল। তাদের দেখতে দেখতে হঠাৎ রাজার ওপর আমার চোখ পড়ল। তার পায়ে এখন আর সে নূপুর নেই। ডানার পালকগুলি কাঁচি দিয়ে গোড়া পার্যন্ত কাটা। সে বেচারার ওড়বার শক্তি তখন একেবারে ছিল না।সে চুপ করে সকলের বাইরে কুণ্ঠিত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে যে একজন বন্দি, এ কথা সে যেন খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছিল। এই অপরিচিত দলের জীবনে প্রবেশ করতে সে কোনো চেষ্টাই করছিল না।

আমি আনন্দে আটখানা হয়ে ‘রাজা রাজা’ বলে ডেকে উঠলুম। আমার পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সে তৎক্ষণাৎ আমার দিকে মুখ ফেরাল, আমাকে দেখে অনন্দে মাথা নাড়াতে নাড়াতে আমার কাছে এল। আমি তাকে হাতে করে বুকের কাছে তুলে নিলুম।আর ‘রাজা’ বলে সাদরে তার মাথায় হাত বুলোতে লাগলুম। সেও তার স্নেহ- কোমল চোখ দুটি দুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘কু-উ-ম’ ‘কু-উ-ম’ বলে পুরানো বন্ধুর সংবর্ধনা করতে লাগল।

রহিম চোরের মত চুপ করে এই পুনর্মিলন দেখছিল। ক্ষণিকের জন্য সে স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। আত্মসংবরণ করে শেষে বলে উঠল, ‘রাজা রাজা কী বলছিস কামাল? এতো তোর পায়রা নয়। আমি যেএকে পরশু দিন নবাবপুর থেকে কিনে এনেছি।’

তার এ নির্লজ্জ মিথ্যা কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে আমি বললুম, ‘কী বলিস রহিম? এ আমার রাজা বই কি! আমি ডাকতেই কেমন চলে এল। আর দেখ, আমার কাছে কেমন চুপটি করে পড়ে আছে। অচেনা পায়রা হলে কী এমন করত?’

রহিম উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘তা বললে কী হয়! ও আমার পায়রা, ওকে ছেড়ে দে’ কথাটা বলেই রাজাকে ধরবার জন্য সে হাত বাড়াল। পাছে রাজার চোট লাগে এই ভয়ে আমি তখন তাকে মাটিতে বসিয়ে দিলুম আর মিনতি করে বললুম, ‘ভাই, আমার পায়রা অমায় ফিরিয়ে দে।’
রহিম মাথা নেড়ে বলল, ‘তাই কি হয়, ও যে আমার কেনা পায়রা।’
আমি বললুম, তাহলে আমি দাম দিচ্ছি আমার কাছে বেচে ফেল।’
রহিম ধীরভাবে বলল, আমি বেচব না।’

রাজাকে তার সেই ঘৃণিত কয়েদ থেকে উদ্ধার করবার কোন উপায় না দেখে আমার মনটা একেবারে দমে গেল,আর আমার চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে উঠল। পাছে রহিম আমার কান্না দেখতে পায়, এই ভয়ে সেখনে আর ক্ষণমাত্র অপেক্ষা না করে আমি অতি ব্যস্তভাবে বাড়ির দিকে চলতে লাগলুম। দূর থেকে রহিমের নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর কানে আসতে লাগল, ‘কোথা যাসরে কামাল? চল না বরজ পোতায় কুল পাড়িগে।’ তার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে সজল চোখে আমি সেদিন বাড়ি ফিরলুম।

এই ঘটনার পর প্রায় দুসপ্তাহ কেটে গেছে। দৈনিক নিয়ম মত বিকেলে আমার পায়রার গৃহ প্রত্যাবর্তনের জন্য আমি পথ চেয়ে আছি। রাজাকে ফিরে পাবার একটা ক্ষীণ আশা এক একবার আমার অন্তরকে কাঁপিয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠছে। আমি উৎসুক ভাবে দিগন্তের দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ আকাশের কোণে একটা ক্ষীণ রেখা দেখে বুঝলুম, আমার পায়রার দল বাড়ি ফিরছে। অন্য দিনের মত আজও আশায় আকাংক্ষায় আমার প্রাণ কাঁপতে লাগল। চোখ দুটিকে হাতের তলায় আড়াল করে আমি দেখতে লাগলুম পায়রার ঝাঁক ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। একে একে সকলকেই চিনতে পারলুম। কিন্তু রাজাকে আজও তাদের মধ্যে দেখতে পেলুম না। নিরাশ মনে আবার খোপের বারান্দার নেমে এলুম। ঝপঝপ করে পায়রাগুলি নেমে এসে বসল; হঠাৎ কীযেন আমার দৃষ্টিকে আকাশের কোণে টেনে নিয়ে গেল। সুদূর চক্রবালে দেখলুম একটা পায়রা আমার বাড়ির দিকে মুখ করে শোঁ- শোঁ করে উড়ে আসছে। আমার নিরাশ মনে আবার আশার সঞ্চার হল। আমি রেলিং- এ ভর দিয়েউচুঁ হবার চেষ্টা করতে না করতে পায়রাটি কাছে এসে পৌঁছাল, আর সোজা এসে ঝপ করে রেলিং- এর ওপর বসে পড়ল।

আমি আনন্দে নেচে উঠলুম। আমার রাজা আবার ঘরে ফিরেছে। সে সেই নিষ্ঠুর তস্করের হাত থেকে পালিয়ে তার বন্ধুজনের কাছে অবার ফিরে এসেছে। তিন সপ্তাহের দীর্ঘ বিরহে সে আমায় ভোলে নি। সুযোগ পেয়েই সে নি:সঙ্কোচে তার আপর জনের কাছে ফিরে এসেছে। রহিমের চালাকি তাকে আদৌ লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি।

আমি একান্ত আগ্রহের সঙ্গে তাকে বুকে তুলে নিয়ে তার মুখ চুম্বন করলুম। তারপর তাকে তার বন্ধুর দলে ছেড়ে দিলুম। তার উচ্ছ্বাসময় ‘বাক বাকুম’ রবে আবার আমাদের বারান্দা ভরে গেল।আমার শোকসন্তপ্ত পায়রার দলের মধ্যে যেন কোন তড়িৎস্পর্শে তাদের পুরনো আনন্দ আবার ফিরে এল।রানী তার বিষাদের বিরল কোণ ছেড়ে আবার দলে এসে মিশল,আর মনের আনন্দে রাজার পাশে দলের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল।আমি একান্ত তৃপ্তির সংজ্ঞে এই মধুর পুনর্মিলন দৃশ্য দেখতে লাগলুম।দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

বিশ্রামের জন্য পায়রারা যে যার খোপে চলে গেল।রাজা তার রানীর সংজ্ঞে আজ তাদের পুরানো খোপে ঢুকলো। আমি সন্তুষ্ট মনে বাইরে এলুম।

রাজার পায়ে নূপুর নেই এ চিন্তা আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠল। আমি তখনই মাধব বেণের দোকান থেকে একটি সুন্দর নূপুর কিনে আনলুম।খাওয়া-দাওয়ার পর সেটাকে মাথার কাছে একটি টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লুম।মনে মনে সংকল্প করলুম,সকালে উঠেই নূপুরটি রাজার পায়ে পরিয়ে দেব।

সে রাতটি আমার বেশ আনন্দেই কেটেছিল।বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত রাজার সাহসের কথা,তার মানুষের মতো বুদ্ধির কথা,তার বন্ধুবাৎসল্যের কথা ভাবতে লাগলুম।এই দীর্ঘ বিচ্ছেদের মধ্যে সে যে আমায় ভোলেনিব এই কথা মনে করে আমার হৃদয় স্নেহে ভরে উঠল। দুষ্ট রহিম কেমন রাগে তার হাত মোচড়াচ্ছে আর গালিগালাজ করে তার মনের ভার লাঘব করছে, তা ভেবে আমি যথেষ্ট তৃপ্তি পেলুম।শুয়ে শুয়েই ঠিক করলুম,তাকে কাল রাজার ফেরবার খবর দিতেই হবে।তার মুখের অবস্থা যে কেমন হবে তা ভেবে যথেষ্ট আমোদ পেলুম।এসব সুখের খেয়ালের মধ্যে আস্তে আস্তে কখন ঘুমিয়ে পড়লুম।

সকালে উঠেই নূপুরটি নিয়ে নিচে বারান্দায় গিয়ে “রাজা” বলে ডাকতে লাগলুম।রাজার কোনো সাড়া না পেয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলুম।অন্যদিনের মতো পায়রাগুলি তাদের জলযোগের জন্য অপেক্ষা করছে না। কেউ ছাদে বসে কাঁদছে, কেউ জড়সড় হয়ে আলিসায় বসে আছে, আভার কাউ নারকেল গাছের ওপর বসে ভীত নেত্রে বারান্দার দিকে চাইছে।রানীকে দেখলুম আলিসায় একটি কোণে মরার মতো বসে আছে। কিন্তু রাহাকে কোথাও দেখতে পেলুম না।হঠাৎ বারান্দায় মেঝের ওপর আমার দৃষ্টি পড়ল।যা দেখলুম তাতে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। মেঝেতে রাশি রাশি পালক ছড়ান রয়েছে, আর জায়গায় জায়গায় রক্তের বড় বড় দাগ।প্রকৃত ঘটনা বুঝতে আমার বাকি রইল না। কোণের কাছে একটা মই দাঁড় করানো ছিল।রাতে সেই মই দিয়ে উঠে খাঠাশে রাজাকে ধরে নিয়ে গেছে।ছেঁড়া পালক আর রক্তের প্রাচুর্যে বুঝলুম রাজা, রাজার মতোই লড়াই করে মরেছে। আর থাকতে পারলুম না।”নানীজান নানীজান! আমার রাজাকে খাটাশে ধরেছে”-বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলুম।

আজ প্রায় ত্রিশ বছর হল রাজাকে হারিয়েছি।তারপর অনেক পাখি পুষেছি,অনেক দেশ ঘুরেছি,অনেক কাজ করেছি,কিন্তু রাজাকে ভুলতে পারিনি। তার সেই “বাক বাকুম” “বাক বাকুম” এখনও আমার কানে ধ্বনিত হচ্ছে, তার সেই সুন্দর মূর্তি এখনও আমার স্নরণে আঁকা রয়েছে।আর তার সেই করুণ গৃহ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতি আজও আমার অন্তরকে ব্যথিত করে তুলছে।

 


পোস্টটি শেয়ার করতে ক্লিক করুন
Scroll to Top