রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে – মার্ক টোয়েন
রাজকুমার যেইমাত্র দরজার বাইরে বেরিয়েছে অমনি দারোয়ান তাকে কষে এক চড় দিয়ে বলল, হে ভিখারির ছেলে, আমাকে রাজকুমারের হাতে বকা খাওয়ানোর জন্য এটা তোর বখশিশ। ভিখারির পোশাকে রাজকুমার মাটিতে পড়া অবস্থায় বলল, বদমাইশ, আমি হচ্ছি রাজকুমার এডওয়ার্ড আর রাজকুমারের গায়ে হাত তোলা মস্ত অপরাধ। তখন দারোয়ান বলল, দূর হ ভিখারি, এখান থেকে। এই সময় রাস্তার লোকজনেরাও তাকে মারল।
তাদের হাত থেকে অনেক কষ্টে বের হয়ে রাজকুমার একা একা পথ চলতে লাগল। চলতে চলতে এক সময় সে এক অচেনা পথে চলে এল। এখানে সে একটা ছোট ছেলেমেয়েদের হোস্টেল দেখল। তখন তার মনে হলো যে, এই হোস্টেল নির্মাণ করছেন তার বাবা। তাই সে সাহস করে হোস্টেলের ভিতর ঢুকে বলল,হে কিশোররা, আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তোমরা ভিতরে গিয়ে বসো ও অন্যদের বলো যে, রাজকুমার এডওয়ার্ড তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
সেখানকার ছেলেমেয়েরা বেশ মজা পেল। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, ছেলেটা নিশ্চয়ই পাগল হবে। ঠিক আছে আমরা সবাই তাকে রাজকুমার মনে করে সম্মান দেখাই। দেখা যাক ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়। তাই সবাই হাঁটু গেড়ে বসে রাজকুমারকে সম্মান দেখাল। তারপর সবাই তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে সামনের পুকুরে ছুড়ে ফেলল। রাজকুমার আবার সবার হাতে অপমানিত হলো।
পুকুর থেকে উঠে সে আবার হাঁটতে লাগল। দিন শেষে রাত্রি ঘনিয়ে এল। তখন রাজকুমার ভাবল: আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। আমার একমাত্র উপায় হলো টমের বাড়ি খুঁজে বের করা। তাহলে তার পিতা-মাতা আমার প্রাসাদের দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললেই হয়তো আমার এই বিপদ কেটে যাবে।
তারপর সে নিকটস্থ বস্তি এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে লাগল। এমন সময় হটাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরল, সে চিৎকার করে উঠল, বাঁচাও বাঁচাও! সেই হাতের অধিকারী তখন বলল, এই বদমাইশ চিৎকার করছিস কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর হাড়গুলি সব পিটিয়ে ভাঙব-না হলে আমার নাম জন ক্যান্টিই নয়। রাজকুমার তখন তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইশ কী সৌভাগ্য আমার! তাহলে তুমিই তার বাবা? লোকটা বলল, কী বলিসরে ছোকরা? আমি তার বাবা নই, আমি তোর বাবা। রাজকুমার বলল, মহাশয় আমার সঙ্গে দয়া করে তামাশা করবেন না। আমি বড় বিপদে পড়েছি। দয়া করে আমার প্রাসাদের দারোয়ানকে যদি আপনি বলে দেন যে, আমি আপনার ছেলে নই, আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস। এ-কথা শোনার পর লোকটা বলল, প্রিন্স অব ওয়েলস,পাগল, তোমাকে বেত দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করতে হবে। তাহলেই তোমার পাগলামি ছুটবে। তারপর টমের বাবা তাকে খুব মারতে লাগল। আর রাজকুমার চিৎকার করতে লাগল, আমাকে যেতে দাও, আমি তোমার ছেলে নই। আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ফাদার এন্ড্রুকে দেখা গেল। তিনি এসে বললেন, থামো ছেলেকে মোরো না, সে অসুস্থ। সে তো তোমার কোনো ক্ষতি করছে না। জন ক্যান্টি তখন রাগের মাথায় ফাদারকে এক ঘা বসিয়ে দিল ও রাজকুমারকে বাড়ির উপরতলায় পাঠিয়ে দিল। তার কিছুক্ষণ পর সে বাড়ির উপরতলায় এসে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, বল তোর নাম কী? রাজকুমার উত্তর দিল, আমি তো তোমায় আগেই বলেছি যে আমার নাম এডওয়ার্ড প্রিন্স অব ওয়েলস। টমের মা তখন আফসোস করে বলে উঠল, টম তুমি যে বই নিয়ে পড়াশুনা করেছ, তাতেই এটা হয়েছে।
রাজকুমার বলল, আমি আপনাকে দুঃখ দেয়ার জন্য দুঃখিত। তবে আমি জীবনে আপনাকে আর কখনো দেখিনি। এ-কথা শুনেই টমের বাবা বেত দিয়ে রাজকুমারকে খুব মারল। রাজকুমার তার রাজকীয় কায়দায় যতই বড় বড় কথা বলে তার বাবা ততই তাকে মারে। অবশেষে টমের বাবা ক্লান্ত হয়ে টমকে ছেড়ে দিয়ে গেল।
ক্লান্ত রাজকুমার খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। টমের মা লক্ষ করল যে টম তার হাত মাথার উপর রেখে ঘুমায়নি। মাথার উপর হাত রেখে ঘুমানোটা টমের অনেক দিনের অভ্যাস। তাই তিনি রাজকুমারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজকুমার মাথায় তার হাত নিয়ে গেল না। এমনিভাবে রাতে তিনি তিনবার এ-কাজটি করলেন। তবুও তিনি স্থির করতে পারলেন না। টমের মায়ের মনে যে সন্দেহ হয়েছিল তা তিনি জোর করে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন মাথায় গোলমাল হবার জন্য বোধ হয় তার পুরোনো অভ্যাসটা বদলে গেছে। এদিকে বেশ গভীর রাতে খবর আসল যে ফাদার এন্ড্রুকে টমের বাবা যে আঘাত করেছিল তার ফলে তিনি মরতে বসেছেন। টমের বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পালানোর কথা স্থির করে ফেললেন। তিনি তাড়াতাড়ি তার স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন: আমি আর টম এখনই চলে যাচ্ছি। তুমি এসে লন্ডন ব্রিজের কাছে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। তারপর রাজকুমারকে নিয়ে জন ক্যান্টি পথে বেরিয়ে দেখতে পেল এক বিরাট উৎসব মিছিল। পথের উৎসবরত লোকেরা তাকে পান করার জন্য পানীয় দিল। জন ক্যান্টি রাজকুমারকে ছেড়ে যেইমাত্র হাত উপরে তুলল এই সুযোগে রাজকুমার ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। তারপর রাজকুমার খোঁজ নিয়ে জানতে পারল রাজকুমারের অভিষেক উপলক্ষে এই উৎসব হয়েছে। তখন সে ভাবতে লাগল: টম ক্যান্টি কি তাকে ফাঁকি দিল? কিন্তু মনে মনে সে বলল: যেভাবেই হউক আমি তার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করব।
এদিকে রাজপ্রাসাদে টম ক্যান্টির অবস্থাও বড়ই করুণ। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলছে বাহ্। আমাকে সত্যি একজন রাজকুমারের মতো দেখা যাচ্ছে। আহ! আমার বস্তির সবাই যদি আমাকে অন্তত একবার এই পোশাকে দেখতে পেত! কিন্তু যতই সময় অতিবাহিত হতে লাগল সে ভীত হয়ে পড়তে লাগল। হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে একটা মেয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল: রাজকুমার আপনার কি কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে? কিন্তু রাজকুমাররূপী টম ক্যান্টি তখন বিড়বিড় করে বলে যাচেছ, আমি হারিয়ে গেছি-আমি হারিয়ে গেছি। এরা এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবে। তারপর সে সেই মেয়েটির কাছেই হাটু গেড়ে বসে বলতে লাগল, আমাকে দয়া করো, আমি রাজকুমার নই আমি টম ক্যান্টি। আমার ছেড়া কাপড়চোপড় আমাকে ফিরিয়ে দাও এবং আমায় বাড়ি যেতে দাও। কিন্তু মেয়েটি কোনো কথা না বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর এখান থেকে সেখানে এমনিভাবে প্রচার হয়ে গেল যে রাজকুমার পাগল হয়ে গেছে। সে অপ্রকৃতিস্থ এবং রাজা নিজে একটা ফরমান জারি পরে সবাইকে সাবধান করে দিলেন যে রাজকুমারের অসুখের কথা যেন রাজপ্রাসাদের বাইরে না যায়।
একদিন টমকে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে রাজাকে দেখে টম ক্যান্টি বলে উঠল, আপনিই হলেন এখানকার রাজা। এই কথা শুনে রাজা বললেন, আমি যে গুজব শুনেছিলাম তা দেখছি সত্যি। রাজা আদর করে তাকে ডাকলেন। কিন্তু টম বলে উঠল, মহাশয়, আপনি আমার বাবা নন এবং আমিও রাজকুমার নই। আমি আপনার অধীন একজন গরিব প্রজা। কোনো এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমি এখানে এসে পড়েছি। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। আমাকে হত্যা করবেন না।