রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে – মার্ক টোয়েন
রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে
– মার্ক টোয়েন
ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনের এক বস্তিতে টম ক্যান্টি নামে একটি ছেলের জন্ম হলো। তার বাপমায়ের মুখে হাসি নেই। কারণ তারা খুব দরিদ্র। তাদের চিন্তা বাড়ল এই ভেবে যে, আরও একটা মুখে খাবার জোটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর ঠিক একই সময়ে একই দিনে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড টিউডরের ঘরে একটি ছেলের জন্ম হলো। এই ছেলের জন্মে রাজ্যময় খুশির ঢেউ বইল এবং নানা আনন্দ-উৎসবের আয়োজন হলো।
রাজকুমার বিজ্ঞ পন্ডিতের কাছে বিদ্যাশিক্ষা নিতে লাগলেন আর বস্তির ছেলে ক্যান্টি বস্তির লোকের কাছ থেকে ভিক্ষা করার শিক্ষা নিল। তবে সে এক ধর্মযাজক ফাদার এন্ড্রুর কাছে কিছু কিছু লেখাপড়া লিখছিল। বিশেষ করে ল্যাটিন শিখছিল। টম ছিল কল্পনা বিলাসী, সে সবসময় রাজা আর রাজকুমারদের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত। সে যতই রাজকীয় কল্পনাতে ডুবে থাকত ততই সবার উপহাসের পাত্র হতো। তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সে রাজকুমার নামেই পরিচিত হতে চাইত। সেজন্য তাদের নিয়ে রাজকীয় সভার অনুসরণ করে নিজে রাজা হতো এবং অন্যদের উপাধি বন্টন করত। ছেলেমেয়েরাও তার এই পাগলামি খেলা উপভোগ করত এবং আনন্দ পেত। সে মনে মনে ভাবত : আহা সত্যিকার রাজকুমারের যদি দেখা পেতাম!
একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে এক অচেনা জায়গায় এসে গেল। সেখানে বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখল। এই অট্টালিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ওয়েস্টমিনিস্টারস প্যালেসে সে এলো। এসে মনে মনে ভাবল, এত বড় অট্টালিকা নিশ্চয়ই কোনো রাজপ্রাসাদ হবে। এমন সময় গেটের ফাঁক দিয়ে সে তার বয়সী এক বালককে সুন্দর পোশাক পরা অবস্থায় দেখতে পেল। তখনই সে মনে মনে ভাবল, এ নিশ্চয়ই সত্যিকারে রাজকুমার হবে। ঠিক এমনি সময় পিছন থেকে তার ঘাড়ে এক পদাঘাত এল। বস্ত্তত এই পদাঘাতটি ছিল দারোয়ানের। সে বলল, এই ভিখারির বাচ্ছা, সরে পড়। কোন সাহসে এখানে এসেছিস? অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গেটের ভিতরের রাজকুমারের নজরে সমস্ত ব্যাপারটা পড়ে গেল। রাজকুমার চিৎকার করে বলে উঠলেন দারোয়ান, আমার বাবার গরিব প্রজার সঙ্গে এমন জঘন্য ব্যবহার করতে তুমি কী করে সাহস পেলে? এখনই দরজা খুলে এই বালককে আমার কাছে নিয়ে এসো।
ভিতরে ঢোকার পর রাজকুমার বললেন, তুমি পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত এবং তোমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে! তুমি আমার সঙ্গে এসো।
কথাটা যেন টমের বিশ্বাস হতে চায় না। সে বলল, ঠিক বলেছেন তো স্যার, আপনার সঙ্গে আসব?
রাজকুমার অভয় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসো।
ক্যান্ট রাজকুমারের সাথে ভিতরে গেল। দুজনাতে অনেক গল্প হলো। রাজকুমার টমকে রাজপ্রাসাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। টমের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। সে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কী সবসময় এই সুন্দর পোশাক পরে থাকতে হয়?
নিশ্চয়ই।
আপনার জীবন কি সুখের!
আর রাজকুমার শুনল টমের বস্তি জীবনের কথা।
সে বলল, যেকোনো সময় নদীতে সাঁতার কাটা যায়, কাদা নিয়ে খেলা করা যায়, একে অন্যের দিকে কাদা ছুড়ে মেরে মজা করা যায়।
তখন রাজকুমার বললেন, তোমার জীবনও নিশ্চয়ই আনন্দে আর খুশিতে ভরা। আহা আমি যদি তোমার পোশাক পরে কাদায় খেলা করতে পারতাম, তাহলে কী আনন্দটাই না পেতাম!
টম বলল, আর আমি যদি আপনার পোশাক পরতে পারতাম তাহলে কী আনন্দই না পেতাম!
রাজকুমার বললেন, তুমি যদি চাও তাহলে আমরা পোশাক বদল করতে পারি। তারপরে তারা উভয়ে পোশাক বদল করে নিল।
তারা উভয়ে একে অপরের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল, কারণ তাদের চেহারা ও পোশাকে কে যে ভিখারির ছেলে আর কে যে রাজকুমার তা কেউ চিনে বের করতে পারবে না। কারণ তাদের দুজনার চেহারা দেখতে হুবহু এক। শুধু পোশাক দ্বারা তাদের ভিন্ন করা যায়। টমের হাতের আঘাত পরীক্ষা করে রাজকুমার বললেন, উহ্! তোমার নিশ্চয়ই খুব লেগেছিল? টম বলল, না, ও
কিছু নয়। আমি এমনি আঘাত আর মার খেয়ে অভ্যস্ত। যে দারোয়ান টমকে মেরেছিল তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের পোশাকে রাজকুমার বাড়ির গেইটের দিকে গেল ও চিৎকার করে বলল, দরজা খোলো। দারোয়ান তার কথামতো দরজা খুলে দিল।