রবিনসন ক্রুশো – ড্যানিয়েল ডিফো

রবিনসন দেখল প্রায় জনা ত্রিশেক লোক বিরাট এক আগুনের কুন্ডলীর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচছে এবং বিদঘুটে আর বীভৎস রকমের চিৎকার করছে। একটু পরেই ওরা দুজন লোককে ওদের সেই নৌকা থেকে টানতে টানতে তীরের বালিতে নামিয়ে নিয়ে এল।

একজনকে তো সাথে সাথেই মেরে ফেলল। আর অন্যজন ওদের একটু অসাবধানতার সুযোগ পেয়ে দৌড় দিল। তিন জন লোক ছুটল ওর পিছু পিছু ওকে ধরতে। কিন্তু লোকটি ছুটছে প্রাণের দায়ে, তার সাথে ওরা পারবে কেন? ঐ লোকটি সোজা ছুটে আসছিল, রবিনসন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে সব দেখছে। প্রথমে ওর ভীষণ ভয় হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল ওদের মধ্যে একজন ফিরে যাচ্ছে তখন রবিনসন বাকি দুজনের হাত থেকে ওকে বাঁচাবে স্থির করল। ওর হাতে ছিল বন্দুক, মধ্যে একটা লোক, রবিনসনের নাগালের মধ্যে আসতেই কষে দিল এক ঘা। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। এদিকে অন্য লোকটি রবিনসনকে নিশানা করে তীর ছুড়ছে দেখেই বাধ্য হয়ে সে গুলি করল।

দ্বিতীয় লোকটি মারা গেল।

যারা তিনজন এসেছিল ওদের তো ব্যবস্থা ভালোই হলো। কিন্তু রবিনসনের বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে এবার যাকে সে বাঁচাল সে-ই ওঠে ভয়ে দিল ভোঁ দৌড়। অতিকষ্টে রবিন ওকে দৌড়ে ধরে আনল এবং তার ভয় ভাঙিয়ে দিল। তখন লোকটি বারবার ওর পায়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল।

রবিনসন ওকে এবার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। কিছু খেতেও দিল, তারপর বিছানা দেখিয়ে বলল ঘুমোতে। লোকটি ভয়ে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিল, এবার ঘুমিয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠেই আবার সে রবিনসনের পা নিজের মাথায় রেখে ওদের প্রথা মতো বশ্যতা মেনে নিল।

এই পুরো ঘটনাটাই ঘটেছিল ইংরেজী ফ্রাইডে, মানে শুক্রবার। তাই রবিনসন ওর নাম রাখল ফ্রাইডে। এতদিন বেচারা রবিনসন ছিল একা দ্বীপবাসী। এবার তার দোসর হলো। ফ্রাইডে কথা বলতে জানত না- তাকে খুব যত্ন করে রবিন কথা বলা শেখাল। এমনিতে ফ্রাইডের মাথা খুব পরিষ্কার, যাকে বলে শার্প। সে অল্পদিনের মধ্যেই সব কাজকর্ম শিখে নিল। তাছাড়া ওর মনিবের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা দেখে রবিনসন খুবই মুগ্ধ হয়। তাইতো পরবর্তী জীবনে রবিনসন ক্রুশো বারবার বলত- ‘অমন বিশ্বাসী ভৃত্য বোধ হয় কেউ কোনোদিন পায়নি, যেমনটি ছিল ফ্রাইডে।’

এভাবে এই নিঝুম দ্বীপে কেটে গেল সাতাশটি বছর। এই সাতাশ বছরে রবিনসনের আরও দুজন সঙ্গী হলো, ওরা কী করে এল শুনো।

পূর্বের মতো একদিন রবিনসন আবিষ্কার করল সমুদ্রতীরে তিনখানা নৌকা। রবিনসন দূরবীন দিয়ে দেখল, আগের মতোই কিছু বর্বর লোক দুটি লোককে বেঁধে রেখেছে, প্রহার করছে এবং আয়োজন চলছে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলবার। তখন রবিনসন আর ফ্রাইডে বন্দুক নিয়ে তাদের আক্রমণ করল। এতে মাত্র চারজন ছাড়া সবাইকে মেরে ফেলল ওরা দুজনে। বাকি চারজন আধমরা অবস্থায় কোনোরকমে ওদের এক নৌকা নিয়ে পালাল। ফ্রাইডে এবং রবিনসন তখন বন্দি দুজনকে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে সুস্থ করে তুলল। এদের একজন স্পেন দেশের লোক আর অন্যজন ফ্রাইডের স্বজাতি। ফ্রাইডে কিন্তু তাকে দেখেই চুমুতে চুমুতে গাল ভরে ফেলল। অস্থির করে তুলল লোকটিকে। কিছু পরে জানা গেল লোকটি আসলে ফ্রাইডের বাবা।

ওরা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে ওদের কাছ থেকে রবিনসন জানতে পারল ডাঙার কাছেই একটা জাহাজডুবি হয়েছে, তাতে কয়েকজন স্প্যানিশ এবং কয়েকজন পর্তুগিজ ছিল যাদের ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে তাদের না আছে অস্ত্র, না আছে কোনো যন্ত্রপাতি। রবিনসন ওদের সব কথা শুনে নিজের দ্বীপে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে সম্মত হলো, কিন্তু শর্ত হবে যে, তারা এখানে সবাই রবিনসনের বশ্যতা স্বীকার করে নেবে এবং কখনো কেউ রবিনসনের বিরোধিতা করবে না। এই শর্তের কারণটাও রবিনসন ওদের বুঝিয়ে বলল, তা হলো, মানুষের সাধারণত স্বভাব হচ্ছে এমন, বিপদের সময় যে উপকার করে, বিপদ কেটে গেলে উপকারীর অপকার করতে ঐ মানুষের মনে বাধে না। এ ক্ষেত্রে বনের পশু বরং উত্তম প্রাণী।

রবিনসন আর ফ্রাইডে ওদের দ্বীপ থেকে ডাঙায় আনার জন্য একটা নৌকাতে ছাউনি তৈরি করল, সাথে রইল খাবার পানি। তারপর সেই নৌকা করেই ফ্রাইডের বাবা আর স্প্যানিশ খালাসিটি ঐ অভাগাদের উদ্ধারে যাত্রা করল।

আরও কিছুদিন পরে একদিন ফ্রাইডে এসে রবিনসনকে খবর দিল- দূরে আবারো একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। রবিনসন খবরটা পেয়ে বেশ খুশিই হলো- তবুও মনের সন্দেহ দূর করতে কী উদ্দেশ্যে জাহাজটি এদিকে আসছে বুঝতে না পেরে আড়াল থেকে ব্যাপারটা পরখ করতে লাগল। ভাবখানা এই, দেখাই যাক না- কী হয়।

জাহাজ তীরের কাছে এসে নোঙর ফেলল, তারপর ঐ জাহাজের লোকেরা নৌকা করে এসে দ্বীপে নামল। আরও একটু সতর্কভাবে দেখে রবিনসন বুঝতে পারল ওরা সবাই শ্বেতাঙ্গ- ইংরেজ, ওর স্বজাতি। আর এই দলের তিনজন লোকের হাত-পা বাঁধা, ওরা বন্দি। যাই হোক, নৌকার লোকগুলো ঐ তিনজনকে চড়ায় ফেলে দিয়ে দ্বীপের ভেতর ঢুকল আর সেই ফাঁকে রবিনসন ওদের বন্দিত্বের কারণটা জেনে নিল।

ওরা বুঝতেই পারছিল না ওরা কোন জাতির লোক, কারণ কেউ কথার উত্তর দিচ্ছিল না। অবশ্য শেষে বুঝতে পারল ওরা রবিনসনেরই স্বজাতি। তাই তারা জানাল, জাহাজের খালাসিরা ষড়যন্ত্র করে ক্যাপ্টেন আর মেটদের বন্দি করেছে- তাদের ইচ্ছে ওদের এই নিঝুম দ্বীপে ফেলে জাহাজ নিয়ে পালাবে। রবিনসন ও ফ্রাইডে তাড়াতাড়ি ওদের বাঁধন খুলে দিল এবং তিনজনের হাতে তিনটি বন্দুক দিল আত্মরক্ষার জন্য। তারপর পাঁচজন মিলে ওদের খুঁজে বের করল। পুরো যুদ্ধের মতো আক্রমণ করল।

ঐ দুষ্টদলের চাঁই ছিল দুজন, প্রথমেই তাদের মেরে ফেলাতে সমস্ত ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেল। আর বাদবাকি যারা ছিল তারা সবাই রবিনসনের কাছে আত্মসমর্পণ করল। ক্যাপ্টেন তখন ঐ তিনজনের সাহায্যে তাদের বন্দি করে ফেলল।

রবিনসন ক্রুশোর জন্যে শুধু ওদের প্রাণই বাঁচাল না, জাহাজটি পর্যন্ত ফিরে পেল। আর সে কৃতজ্ঞতায় ওরা রবিনসনকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। রবিনসন ক্রুশো স্প্যানিশদের জন্যে অপেক্ষা না করে, যা-কিছু ব্যবহারের জিনিসপত্র ছিল সব গুছিয়ে রেখে সেগুলো তাদের ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়ে একটা চিঠি লিখে রেখে ফ্রাইডেকে নিয়ে জাহাজে উঠল।

আটাশ বছর পরে এই এতদিনের অজানা দ্বীপ ছেড়ে রবিনসন ক্রুশো দেশের দিকে চলল এবং পঁয়ত্রিশ বছর পরে আবার দেশের মাটিতে পা দিল।


পোস্টটি শেয়ার করুন