রবিনসন ক্রুশো – ড্যানিয়েল ডিফো
পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দেখল আকাশ পরিষ্কার, ঝড় উঠেছিল বলে মনেই হয় না। আরও আশ্চর্য, ঝড়ের বেগ ওদের বড় জাহাজটাকে প্রায় ডাঙাতেই নিয়ে এসেছে। রবিনসন ভাবল, আমরা যদি জাহাজেই থাকতাম তাহলে কাউকেই মরতে হতো না।
এখন আর ভেবে কী হবে? রবিনসনের খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড। সে আবার জাহাজে গিয়ে উঠল- এবং খুঁজে দেখল খাবারগুলো ঠিক আছে কি না। খাবার ঠিকই ছিল। সে বেশ পেট পুরে খেয়ে নিল। তারপর জাহাজ থেকে কয়েকটা তক্তাকাঠ আর ছুতোরের যন্ত্রপাতি তীরে এনে কোনো রকমে রাত কাটানোর মতো একটা মাচা তৈরি করে নিল। তারপর বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্বীপটা ভালো করে দেখার জন্য। কিন্তু পাহাড়ের উপর উঠেই রবিনের মনটা দমে গলে। ঈশ্বরই জানেন কতদিন থাকতে হবে এই দ্বীপে।
রাতে অবশ্য কোনো রকম ঝামেলা হলো না। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে রবিন স্থির করল, প্রয়োজনীয় যেটি কিছু জাহাজে এখনো ভালো আছে তা সবই নামিয়ে আনতে হবে।
সেদিন থেকে সময় পেলেই ভাটার সময় পানি কমতেই সে জাহাজে চলে যেত এবং নামিয়ে আনত প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্তর। বেশিদিন সময় পেলে রবিনসন হয়তো পুরো জাহাজটাই ডাঙায় তুলে নিয়ে আসত। পারল না, কারণ চৌদ্দ দিনের মাথায় এমন ঝড় উঠল তাতে ঐ ভাঙা জাহাজটা ঝড়ে কোথায় উড়ে গেল তার কোনো চিহ্নও পাওয়া গেল না।
অবশ্য জাহাজ থেকে রবিন কম জিনিস নামিয়ে আনেনি। এখন এসব জিনিস রাখবে কোথায় সেটাও এক ভাবনা। অনেক খুঁজে একটা পাহাড়ে ওঠার মধ্যপথে খানিকটা সমতল জায়গা আবিষ্কার করল। ওর উল্টো দিকে উঠে গেছে একটা খাড়া পাহাড়, সেদিক থেকে কোনো বন্য জানোয়ারের আক্রমণের সম্ভাবনাও খুবই কম। আর বাদবাকি তিনদিকে সে নারকেল পাতা দিয়ে বেশ শক্ত এবং উঁচু করে বেড়া দিয়ে দিল। প্রয়োজন হলে মই লাগিয়ে সে যাতায়াত করত, আর ভেতরে ঢুকেই মইটা তুলে নামিয়ে রাখত মাটিতে।
সব জিনিসপত্র রাখল সেখানেই। তৈরি করল বড় করে একটা থাকার মতো ছাউনি। তাছাড়া পাহাড়ের একটা অংশে প্রকান্ড এক গর্ত ছিল, সেটাও যোগ করে নিল ঘর হিসেবে।
থাকার মতো বাসা তৈরি হয়ে গেল ওর। ভাবল তৈরি করতে হবে কিছু আসবাবপত্র। যদিও এসব তৈরির অভ্যেস ওর নেই। যন্ত্র ব্যবহার করতে ওর খুব কষ্ট হলো। প্রথমে বন থেকে কাঠ নিয়ে তৈরি করল একটা চেয়ার। তারপর টেবিল, শেলফ, আরও কত কী! একধরনের শক্ত জংলাগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করল একটা কোদাল আর জাহাজের ভাঙা একটা লোহার টুকরো পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করল জ্বালানি কাঠ কাটা কুড়াল।
এর মধ্যে ঘটল এক মজার ঘটনা। রবিনসন জাহাজ থেকে নামানো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেই পেল একটা ছোট থলে, খুলে দেখল তাতে রয়েছে কতটা তূষ। থলেটা ওর দরকার ছিল ভিন্ন কারণে- তাই ঘরের বাইরে এসে তূষগুলো মাটিতে ফেলে দিল।
এর কিছুদিন পরেই নামল বর্ষা এবং বৃষ্টি। বৃষ্টি হবার কয়েক দিন পরেই রবিনসন আশ্চর্য হয়ে দেখল, যে তুষগুলো সে ফেলেছিল সেখানে অজানা গাছের বেশকিছু অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। রবিনসনের খুব আনন্দ হলো। সে কোদাল দিয়ে সামনের আরও কিছু জমি কুপিয়ে তৈরি করে রাখল। একদিন দেখল অংকুরগুলো আসলে ধানগাছের- সাথে যবও আছে।
একদিন ধান আর যব গাছগুলো একটু বড় হলে সে তা চষাজমিতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বুনে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই ঐ জমি থেকে বেশকিছু ধান ও যব পেল।
এবার রবিনসনের ভাবনা- এগুলো মাড়াই করবে কীভাবে? তাছাড়া চাই জাঁতাকল আর রুটি সেঁকবার জন্য তাওয়া। যাই হোক, বুদ্ধিমান রবিন শক্ত কাঠ দিয়ে জাঁতা তৈরি করল, আর নরম মাটি থালার মতো পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করল তাওয়া।
এবার বড় সমস্যা হলো পোশাকের! জাহাজে যেটি ছিল তাতে আর কতদিন চলে? সেই বনে তো আর যাই হোক, পোশাক বা তৈরি কাপড় পাওয়া যাবে না। তখন আবার নতুন বুদ্ধি আঁটল রবিন- ঘরে রাখা ছিল বেশকিছু শুকনো ছাগলের চামড়া- সে ঐ চামড়া দিয়েই লজ্জা ঢাকার মতো পোশাক তৈরি করে নিল। গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ আর তার উপর ছাগলের চামড়ার পোশাক- যেটি একখানা চেহারা হয়েছে রবিনসনের। ওভাবে দেখলে ওর স্বজাতি হয়তো অজ্ঞান হতো কিংবা ধরেই নিত রবিনসন পাগল হয়ে গেছে।
রবিনসনের আরও একটা মজার কথা হলো পৃথিবীর সাথে সম্পর্কহীন এক দ্বীপে বাস করলেও সে দিন-মাস বছরের হিসেব ঠিক ঠিক রেখেছিল। যেদিন রবিনসনের নৌকোডুবি হয় সেদিনের তারিখ ওর জানা ছিল- তারপর থেকেই রবিন প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে পরপর তারিখ লিখে ক্যালেন্ডার তৈরি করে রেখেছিল। প্রত্যেকদিন সকালে উঠে একটা করে তারিখ কেটে দিত সে। ঠিক বর্তমানের ডেটকার্ড বদলানোর মতো।
এভাবেই রবিনসনের দিনের পর দিন কাটতে লাগল। রবিনসন ঐ দ্বীপের মুকুটহীন রাজা। যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই ওর রাজত্ব। রবিনসন যখন খেতে বসত তখন ওর সব কুকুর বেড়ালগুলো বসত চারপাশে, তা দেখে মনে হতো রবিনসন রাজা আর ওরা সব যেন প্রজা, প্রজারা যেন সব ওর করুণা প্রত্যাশী। কিন্তু এভাবে বেশিদিন কাটল না, কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিল নতুন এক অশান্তি।
রবিনসন একদিন বেলাভূমিতে হাঁটছিল বালি কেটে কেটে নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে। এর মধ্যেই হঠাৎ তার চোখ স্থির হয়ে যায় বালির ওপর প্রকান্ড এক পায়ের ছাপ দেখে। কিন্তু কোথাও জন মানব নেই, এই ছাপ এল কীভাবে, চিন্তা ওখানেই। কোনো কিছুর সন্ধান পেল না বলেই ওর ভীষণ ভয় হলো। শেষে এমন হলো, দিনে ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করলেও রাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখল, কিছু লোক ওকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। অবশ্য ওর ঘর খুব মজবুত করে তৈরি। তবুও রবিন আবার দ্বিগুণ দেয়াল তৈরি করল, যাতে করে ওর ঘর শত্রুর কাছে দুর্ভেদ্য হয়। অবশ্য তাতেও রবিনসনের পুরো ভয় কাটল না।
যাই যাই করে এভাবে কেটে গেল প্রায় দুটি বছর। রবিনসন এখন সেসব ভয়ের কথা প্রায় ভুলেই বসেছে। এমনি এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেতেই দেখতে পেল পাঁচখানা নৌকা সাগরের তীরে বাঁধা। আরও স্পষ্ট করে দেখার জন্য রবিনসন পাহাড়ের উপর উঠল। সেখানে থেকে যেটি দেখল, তাতে ওর হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয় আর কি!