রবিনসন ক্রুশো – ড্যানিয়েল ডিফো
রবিনসন ক্রুশো
– ড্যানিয়েল ডিফো
রবিনসন ক্রুশো ইয়র্ক শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। ওর বাবা ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং ওর বাবার ইচ্ছে ছিল আইন পাস করে সে ওকালতি করুক। কিন্তু রবিনের কেমন যেন একটা ঝোঁক ছিল মাথায় এবং তা ছেলেবেলা থেকেই-তা হলো, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। বিশেষ করে তা যদি সমুদ্রযাত্রা হয় তবে তো কথাই নেই। বড় হয়ে তাই সে তার মা-বাবার কথা না-শুনে বাড়ি থেকে না বলে বেশকিছু পাউন্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়ল লন্ডনের উদ্দেশে।
কিন্তু যাত্রার প্রথম থেকেই ওর দুর্ভাগ্য দেখা দিল। ইয়র্ক থেকে লন্ডনে আসার জন্য জাহাজে উঠল কিন্তু জাহাজটি ইয়ারমাউথ নামক স্থানে ডুবে গলে। ভাগ্য ভালো, অন্য একটি জাহাজ যাচ্ছিল ওদের সামনে দিয়ে ওরা ওদের লাইফবোটে সকলকে তুলে নিল। ক্রুশো কাছে যেটি অর্থ ছিল তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত লন্ডন শহরে এসে সে পৌঁছল।
লন্ডনে আসার কদিন পরে জাহাজ-মালিকের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। ভদ্রলোক জাহাজের ব্যবসা করেন এবং এ কারণে প্রায়ই গিনি উপকূলে যাতায়াত করেন। একদিন তিনিই রবিনসনকে বললেন- ‘তুমি যদি কিছু মনিহারি মালামাল নিয়ে আমার জাহাজে করে গিনি উপকূলে যাও তাহলে মোটা অঙ্কের টাকা লাভ করতে পারবে।’ রবিনসন এই ধরনের কিছু একটা করতে চেয়েছিল। তাই সে লন্ডনের বসবাসরত তার কিছু আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে কিছু পাউন্ড ধার করল এবং সে ঐ পাউন্ড দিয়ে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা, কিছু পুঁতির মালা এবং আরও এমন কিছু কিনে নিল যেটি ঐ অঞ্চলের লোকজন পছন্দ করবে। এবার ঈশ্বরের নাম নিয়ে গিনির পথে সমুদ্রযাত্রা শুরু হলো।
প্রথম যাত্রাতেই ওর মোটামুটি বেশ লাভই হলো। অঙ্কের হিসেবে ৫ পাউন্ডের জিনিস সে বিক্রি করেছে ২০ পাউন্ডে। এবার ওর আনন্দ দেখে কে! লাভ হলো দুরকম-টাকা তো লাভ হলোই, তার নিজের চেষ্টায় জাহাজ চালানোও কিছু শিখে ফেলল। অবশ্য অল্পতে বেশি লাভের আশায় গিনিতে পরবর্তী যাত্রায় কী ঘটেছিল এবার তার বর্ণনা। গিনি থেকে বাণিজ্য করে ফিরে আসার পথে কয়েকজন মুর জলদস্যু ওর জাহাজ আক্রমণ করল, এবং ওকেসহ সবাইকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করে দিল।
অবশ্য রবিনসনকে যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল সেই মনিব ছিল খুব ভালো। মনিব ভদ্রলোকের ছিল মাছধরার নেশা। মাছ কী করে ধরতে হয় রবিন তা ভালো করে জানত এবং সেই একটিমাত্র কারণে রবিন মনিবের আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠল।
যা হোক, রবিনসন তার মাথা থেকে পালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা বাদ দেয়নি। অবশ্য পালিয়ে যাবার পথটা কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না। প্রায় বছর দুই পরে একদিন ওর সুযোগ হলো পালানোর। রবিন ওরই এক সমবয়সী মুর ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছিল মাছ ধরবে বলে- কৌশল করে নৌকাটা একটু গভীর সমুদ্রে নিয়ে মুর ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সমুদ্রে, আর ভয় দেখাল ফিরে না গেলে গুলি করে মারবে।
আশ্চর্য ঘটনা হলো, মুর ছেলেটি ওকে ভয় না পেয়ে বরঞ্চ সাহায্য করতে রাজি হলো। ছেলেটিকে রবিনসন আবার নৌকায় তুলে নিল।
আবার যাত্রা শুরু হলো। দুদিন বেশ কষ্ট করে চলার পর একটা পর্তুগিজ জাহাজের দেখা পেল। জাহাজ ওদের কাছে আসতেই ওরা জাহাজিদের সব জানাল। জাহাজিরা ওদের তুলে নিল জাহাজে এবং রবিনসনকে এনে নামিয়ে দিল ব্রাজিলের বন্দরে এবং জাহাজি নিজের জন্য মুর ছেলেটিকে রেখে দিল।
কিছুদিন ব্রাজিলে ওর বেশ সুখেই কাটল। অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করে নিজের অবস্থা ফিরিয়ে এনেছিল রবিন। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অস্থিরচিত্ত রবিনের মাথায় আবার দুর্বুদ্ধি চাপল। ওখানকার স্থানীয়রা ওকে পরামর্শ দিল আবার গিনির সেই পুরোনো বাণিজ্যটা শুরু করতে। ওর তো সমুদ্রযাত্রার পুরোনো নেশা আছেই। তাই একদিন আবার তোড়জোড় করে বেরিয়ে পড়ল গিনির উদ্দেশে।
সমুদ্রযাত্রার প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভালোই যাচ্ছিল, হঠাৎ একদিন উঠল ভীষণ সামুদ্রিক ঝড়। সেই ঝড়ের মধ্যে ওদের জাহাজ গিয়ে আটকে গেল এক অজানা চড়ায়। আর চড়ার বালিতে জাহাজের তলা গেল ভীষণভাবে ফেঁসে। তবু অনেক ভেবে ওরা জাহাজে রক্ষিত ছোট নৌকায় করে ডাঙায় দিকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম, প্রচন্ড এক সমুদ্রের ঢেউ এসে ওদের নৌকাটা উল্টে দিল এবং ওরা সবাই ডুবে গেল। রবিনসনের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, সে ভেসে উঠল এবং সাঁতার কেটে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় কূলে পৌঁছল। সেই রাতটা সে বন্য জীবজন্তুর ভয়ে একটা গাছের উপর বসে কাটিয়ে দিল।