যদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা

ষোলো

ইংরেজ কবি শেকসপীয়র বলতে গেলে বেবাক জীবনটা লন্ডনে কাটিয়েছিলেন। তবু তাকে অ্যাবন নদীর পাড়ের ছাওয়াল বলতে অনেকে কুণ্ঠাবোধ করেননি। জার্মান কবি গ্যোতে তিরিশের কোঠায় পা রাখার সময়ে জন্মভূমি ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়ে ভাইমারে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বিরাশি বছরের দীর্ঘজীবনের সবটাই ভাইমারে কেটেছে। তথাপি তাকে মাইন তীরবর্তী ফ্রাঙ্কফুর্টের ছাওয়াল বলা হয়।

প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে যদি একটা মাত্র পরিচয়ে শনাক্ত করতে হয়, আমার ধারণা ‘ঢাকার পোলা’ এর চাইতে অন্য কোনো বিশেষণ তার সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেছেন। সেটাই তাকে ঢাকার পোলা বলার একমাত্র কারণ নয়। ঢাকার যা-কিছু উজ্জ্বল গৌরবের অনেক কিছুই প্রফেসর রাজ্জাকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি সবসময়ে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলেন। ঢাকাইয়া বুলিতে যে একজন সুশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোক মনের গহন ভাব অনুভাব বিভোব প্রকাশ করতে পারেন এবং সে প্রকাশ কতটা মৌলিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে, রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা যিনি শোনেননি, কোনোদিন বুঝতে পারবেন না। ঢাকার পুরোনো দিনের খাবারদাবার রান্নাবান্না যেগুলো হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যাওয়ার পথে প্রফেসর রাজ্জাক তার অনেকগুলোই ধরে রেখেছেন। তার বাড়িতে এখনও প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে একটা দুটো পদ ঢাকার খাবার রান্না করা হয়। খাওয়াদাওয়া, বান্নাবান্না, আচার-আচরণের ঢাকাইয়া বৈশিষ্ট্যগুলো প্রফেসর রাজ্জাক এবং তার পরিবার অতি সযত্নে রক্ষা করে আসছেন। নানা দেশের খাবার এবং রান্নাবান্নার প্রতি প্রফেসর রাজ্জাকের বিলক্ষণ অনুরাগ আছে। তার বাড়িতে বিদেশী খাবার রান্না হয় না এমন নয়। যখনই তিনি দেশের বাইরে গিয়েছেন, কমপক্ষে একপদ হলেও রান্না শিখে এসেছেন। ল্যাবরেটরিতে যেভাবে কেমিক্যাল কম্পাউন্ড পরীক্ষা করা হয়, সেরকম নিক্তি মাপা সতর্কতা সহকারে নতুন ভিনদেশী খাবার রান্না করা হয়। তাঁর পরিবারের মহিলারা বিদেশী খাবার পরীক্ষানিরীক্ষায় একরকম পারদর্শিতা অর্জনও করে ফেলেছেন। কিন্তু দেশীয় খাবার, বিশেষ করে পুরোনো দিনের খাবারের মর্যাদার জায়গাটি ভিনদেশী খাবার কখনো অধিকার করতে পারেনি। ঢাকার পুরোনো দিনের খাবারদাবারের প্রতি তার যে মমত্ববোধ, সেটা আমার কখনো অন্ধ ঐতিহ্যপ্রীতি মনে হয়নি। ঢাকার খাবারের কদর তিনি করেন, কারণ ওগুলো যথার্থই ভালো। উৎকর্ষের দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশের খাবারের সমকক্ষ।

ঢাকার খাবার এবং ঢাকাব বুলি নয় শুধু, তার চরিত্রের আঁশে শীষে আরও এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য আছে যে-কেউ রাজ্জাক সাহেবের সংস্পর্শে এসেছেন, নিশ্চয়ই উপলব্দি করতে সক্ষম হবেন, এই মানুষের জন্ম ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব ছিল না। তার মুখের ভাষা, খাবার এবং পোশাক আশাক সবকিছুর মধ্যে এমন কতিপয় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে, অন্য যে-কোনো মানুষের বেলায় সেটা বাড়াবাড়ি মনে হত। রাজ্জাক সাহেবের বেলায় সেটা মোটেই মনে হয় না এবং এটাই আশ্চর্যের। তিনি যখন বাজার করতে যেতেন, সব সময়ে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরতেন। কখনো গলায় চাদর থাকত, কখনো থাকত না। ইদানীং চলাফেরা করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে, শরীরে কুলোয় না। বাড়িতে যতোক্ষণ থাকেন গলার দুপাশে একটা গামছা পেঁচিয়ে রাখেন। প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে একজন মাঠের কৃষক ছাড়া কিছুই মনে হওয়ার কথা নয়।

এই রচনার নানা অংশে তার জ্ঞানবিদ্যার কিছু পরিচয় তুলে ধরতে চেষ্টা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিতদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, বিলেত আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার কীরূপ সমাদর সেসব বিষয়েও কিছু কথাবার্তা প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে। প্রফেসর রাজ্জাকের চরিত্রের প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি আমি সবসময়ে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করে আসছি, সেটি হল তার নিজের দেশ, সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারবোধই প্রফেসর রাজ্জাককে অন্য সকলের চাইতে আলাদা করেছে। ইংরেজিতে যাকে ইনটিগ্রিটি বলা হয়, বাংলায় আমি এ মুহুর্তে তার কোনো সঠিক প্রতিশব্দ খুঁজে পাচ্ছিনে। সবদিক মিলিয়ে এক ধাতুতে তৈরি করা ব্লকের মতো ইনটিগ্রিটিসম্পন্ন মানুষ বাঙালি মুসলমানসমাজে একজনও দেখিনি। হিন্দুসমাজে সন্ধান করলে হয়তো কতিপয় পাওয়া যেতে পারে।

প্রফেসর রাজ্জাক বাঙালি মুসলমানের দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে দেখেছেন এবং বিচার করেছেন। আবার পৃথিবী-দেখা চোখ দিয়ে বাঙালি মুসলমানসমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। নিজস্ব সামাজিক অবস্থানের ওপর দাড়িয়ে এবং নিজের সামাজিক পরিচিতির আদি বৈশিষ্ট্যসমূহ গৌরবের সঙ্গে ধারণ করে একটা বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বাঙালি মুসলমানসমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সাবালক করার পেছনে তাঁর যে ভূমিকা তার সঙ্গে কারও তুলনা হতে পারে না। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়ার প্রয়োজন আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্ৰিক যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয়েছিল, মুসলিম সমাজে মুক্ত চিন্তার চর্চার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই আন্দোলনের কুশীলবদের অনেকেই রাজ্জাক সাহেবের চাইতে বয়সে বড় ছিলেন। কাজী মোতাহের হোসেন ছিলেন ওই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিবৃন্দের একজন। রাজ্জাক সাহেব কাজী সাহেবের গুণমুগ্ধ এবং স্নেহভাজন ছিলেন। তথাপি ওই আন্দোলনের মৰ্মবেগ যে তাকে স্পর্শ করেছিল এমন মনে হয় না। উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তসমাজের লোকেরা পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ধর্ম এবং সামাজিক সংগঠনের মধ্যে যে ধরনের সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক মুসলিম সাহিত্যসমাজের তরুণেরা ব্ৰাহ্মসমাজের আদলে বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তাভাবনা রূপায়িত করার চেষ্টা করতেন। অন্তত ব্রাহ্মসমাজের জলছবিটা তাঁদের অনেকেরই মনে ক্রিয়াশীল ছিল। সেই জিনিসটি রাজ্জাক সাহেবকে টানেনি। রাজ্জাক সাহেব উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের জাগরণ হিন্দুসমাজের ওপরতলার জনগোষ্ঠীর একটা অংশে যে-সকল রূপান্তর বয়ে এনেছিল, বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশ ছাড়া তার অনেক কিছুই মুসলমানসমাজের জন্য ইতিবাচক এবং অনুকরণযোগ্য, তিনি একথা মনে করতে পারেননি। হিন্দুসমাজ থেকে উদ্ভূত চিন্তাভাবনা হিন্দুসমাজকে ঘিরেই আবর্তিত হত। সেই সঙ্কীর্ণ বলয় সম্প্রসারিত হয়ে কখনো মুসলমানসমাজকেও কোল দেবে সে যুগের অন্যান্য মুসলিম কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের মতো রাজ্জাক সাহেবও বিশ্বাস করতে পারেননি।

প্রফেসর আবদূর রাজ্জাক পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তিনি কী কারণে পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার একটা কৈফিয়ত তিনি দিয়েছেন। এটা গ্রহণযোগ্য কৈফিয়ত কি না বিচারের ভার অন্যদের। ভারতবর্ষকে খণ্ডিত না করে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের হয়তো পন্থা ছিল, কিন্তু সেটা কেউ অনুসরণ করেনি। যদি আর কিন্তু দিয়ে ইতিহাস হয় না। যা ঘটে গেছে তাইই ইতিহাস। এই অঞ্চলে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল। রাজ্জাক সাহেব মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তান দাবির সমর্থক ছিলেন। সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেই বাংলার মুসলমান সমাজের উপকার হবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ধারণাটিও রাজ্জাক সাহেবের মস্তক থেকে এসেছিল। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হয়েছে। এক-জাতিতত্ত্বের বদলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিজয় সূচিত হয়েছে। পাকিস্তান ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে দ্বি-জাতিতত্ত্বের মৃত্যু ঘটলো, কিন্তু এই ঘটনা এক-জাতিতত্ত্ব সত্য প্রমাণিত হওয়ার স্বীকৃতি, নাকি ভারতবর্ষে বহু-জাতীয়তার উদ্বোধন, সেই বিষয়টি এখনও সুস্পষ্ট আকার লাভ করেনি। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন রূপান্তরের মধ্যে রাজ্জাক সাহেব যে অবস্থানটি গ্রহণ করেছিলেন, তা সঠিক কি বেঠিক ছিল সে বিতর্কেও আমি প্রবৃত্ত হবো না। আমি শুধু একটি কথাই জোর দিয়ে বলবো, রাজ্জাক সাহেব মনেপ্ৰাণে একজন খাটি সেক্যুলার মানুষ। কিন্তু বাঙালি মুসলমানসমাজের সেক্যুলারিজমের বিকাশের প্রক্রিয়াটি সমাজের ভেতর থেকে, বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তর থেকে বিকশিত করে তুলতে হবে, একথা তিনি মনে করেন।

রাজ্জাক সাহেব একটা বিশেষ যুগ, বিশেষ সময়ের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় দশকের দিকে রাজ্জাক সাহেব ছিলেন ছাত্র এবং তৃতীয় দশকে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এই রচনায় অন্তত এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার একটি পাকিস্তান আন্দোলন, অন্যটি ভাষা আন্দোলন এবং পরেরটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। রাজ্জাক সাহেবের জীবন ওই তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অহংবোধ এই তিনটি ঘটনায় তিনবার তিনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একটার সঙ্গে আরেকটার বহিরঙ্গের দিক দিয়ে পার্থক্য থাকলেও একটা মূলগত ঐক্যের কথা কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজ্জাক সাহেবকে বাঙালি মুসলমানসমাজের ঐতিহাসিক হংবোধের প্রতীক বললে অধিক হবে না। তথাপি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সনাতন মুসলিম লীগপন্থীদের সঙ্গে পুরোপুরি এক না হলেও সর্বাংশে উদার একথা মানতে অন্তত আমার বাধবো। উনিশশো তিরিশ সালের পর যে বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীটি বাংলার মুসলমানের আশা-আকাঙক্ষার ধারক বাহক হয়ে উঠেছিল, রাজ্জাক সাহেব ছিলেন তাদের মধ্যে সবচাইতে শানিতাদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে-সমস্ত বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের জন্ম-প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, রাজ্জাক সাহেব তাতে একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তার চরিত্রের একরৈখিকতা, অনাপোসি মনোভঙ্গি এবং একান্ত মুসলিমসমাজভিত্তিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে একটা প্রবণতা অনায়াসে লক্ষ করা যাবে, সেগুলো যতোটা নিরপেক্ষ ইতিহাস অনুধ্যানের ফল ততটা হিন্দুসমাজের প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত অভিব্যক্তি। যে সময়ে, যে সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, যে সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন, তার প্রভাব পুরোপুরি অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তথাপি ভাবতে অবাক লাগে তিনি যে প্রজন্মের মানুষ, সেই প্রজন্মকে কতদূর পেছনে ফেলে এসেছেন। পরবর্তী অনেকগুলো প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানসকর্ষণের দীক্ষা দিয়েছেন। বলতে গেলে কিছুই না লিখে শুধুমাত্র সাহচৰ্য, সংস্পর্শের মাধ্যমে কত কত আকৰ্ষিত তরুণচিত্তের মধ্যে প্রশ্নশীলতার অন্ধুর জাগিয়ে তুলেছেন, একথা যখন ভাবি বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না।


পোস্টটি শেয়ার করুন