মহাপতঙ্গ – আবু ইসহাক

মহাপতঙ্গ
– আবু ইসহাক

ছোট এক শহরের ছোট এক বাড়ি। সেই বাড়ির উত্তর দিকের দেওয়ালের ফোকরে থাকত একজোড়া চড়ুই পাখি। একদিন কুড়িয়ে খেতে মাঠে গিয়েছিল ওরা, হঠাৎ কেমন অত শব্দ শুনে ওরা সচকিত হয়ে ওঠে। মাথা তুলে একে অন্যের দিকে তাকায়।

দূর থেকে বোঁ-বোঁ শব্দ ভেসে আসছে।

চড়ুই দুটো ভয় পায়। ফুড়ুৎ করে ওরা গাছের ডালে গিয়ে বসে। শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। চারদিকের পাখপাখালি উর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে। চড়ুই পাখি দুটো পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। দূর দিগন্ত থেকে প্রকাণ্ড একটি কী এদিকেই উড়ে আসছে। ভয়ে ওরা ঘন পাতার ভেতর লুকিয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর বোঁ-বোঁ আওয়াজ করতে করতে ওদের মাথার ওপর দিয়েই ওটা চলে যায়।

বুক দুরু দুরু করে দুটোরই। কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চড়ুই ওর সঙ্গিনীকে বলে,

-চিনতে পেরেছ তো ?

-উঁহু।

-আরে! বাবা তো এটার কেচ্ছাই শুনিয়েছিল একদিন, মনে নেই?

-অহ হো, মহাপতঙ্গ?

-হ্যা, হ্যাঁ তাই।

চড়ুই পাখি দুটোর শিশুকালের কথা। পুরাতন এক বাড়ির দেওয়ালের ফোকরে ছিল ওদের মা-বাবার নীড়। মা-বাবার ডানার মধ্যে মুখ লুকিয়ে ওরা তখন রাক্ষস-খোক্ষস আর দেও-দুরাচারের কেচ্ছা শুনত। ছোঁ-রাক্ষস, ম্যাও- খোক্ষস, কুণ্ডলী-ফোঁসফোঁস ও কা-ভক্ষুসের কথাই বেশি করে বলত মা-বাবা। কারণ এগুলোই ওদের প্রধান শত্রু। 

এক অন্ধকার রাতে মা ছোঁ-রাক্ষসের গল্প বলছিল। ছোঁ-রাক্ষস আমাদেরই মতো পাখাওয়ালা আকাশচারী জীব। ওদের দৃষ্টি খুব তীক্ষ। ওরা মটির দিকে চোখ রেখে আকাশে ভেসে বেড়ায়, সুযোগ পেলে চোখের পলকে ছোঁ মেরে বাঁকা নখে বিধিয়ে ধরে নিয়ে যায়। তারপর গাছে বসে ঠোকর মেরে চোখ খায়, বুক খায়, কলজে খায়।

ছানা দুটো ভয়ে ওদের মার ডানার মধ্যে মুখ লুকায়। জোছনা উঠলে ওদের ভয় কমে। তখন নর-ছানাটা শুধায়, –

আচ্ছা মা, সবচেয়ে বড় পাখি কোনটা?

-তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর। উনি দেখেছেন। বল না গো, সেই বড় পাখির গল্পটা। 

-হ্যাঁ বলছি। অনেক আগে। আমরা তখন ছিলাম অনাবৃষ্টির দেশে। তোদের মা ডিমে তা দিচ্ছিল। আমি গিয়েছিলাম কুড়িয়ে খেতে। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। চেয়ে দেখি অতি প্রকাণ্ড এক পাখি বোঁ-বোঁ আওয়াজ তুলে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে অনেক দূর দিয়ে- আকাশ যেখানে গাছের মাথায় ঠেকেছে সেখান দিয়ে। এত বড় বিরাট পাখি আর কখনও দেখিনি।

-এটা কি ছোঁ -রাক্ষসের মতো ছোঁ মারে? মাদি ছানাটা রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

-তা তো দেখিনি, মা। ঐ একদিনই দেখেছি ওটা। ওটা দেখতে? ইতস্তত করে চড়ুই। -হ্যাঁ, ওটা দেখতে অনেকটা ফড়িং-এর মতো। লেজ-লম্বা ফড়িং দেখেছিস তো? ঐ যে বৃষ্টির দিনে একটা মেরে এনে তোদের খাইয়েছিলাম।

-হা হা, দেখেছি। দুটো ছানাই বলে।

-সেই ফড়িং-এর মতো পাখা আর লম্বা লেজ। সে এক মহাপতঙ্গ। কত যে বড়, না দেখলে বোঝা যাবে না।

বোঁ-বোঁ শব্দ করে উড়ে বেড়ায়।

পিতার বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আজকের এ আকাশচারী জীবটা মহাপতঙ্গ না হয়ে যায় না।

পক্ষিরাজ্য ভীত – সন্ত্রস্ত। এরকম পাখি এর আগে কেউ কখনও দেখেনি এ দেশে। গাছে গাছে পাখিদের জরুরি সভা বসে। 

এক পাখি বলে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমার মনে হয় এটা শস্যভোজী। মাংসভোজী রাক্ষস নয়। প্রতিবাদ করে অন্য পাখি বলে, না, না, এটা নিশ্চয় রাক্ষস পাখি। রাগের চোটে কেমন বোঁ-বোঁ করছিল।

আর এক পাখি সমর্থন করে বলে, ঠিকই, এটা রাক্ষস পাখি। তর্জন-গর্জন শুনেও বুঝতে পার না তোমরা? এটা খপাখপ ধরবে আর টপাটপ গিলবে। যদি বাঁচতে চাও, তবে এ দেশ ছেড়ে পালাও।

পালিয়ে যায় অনেক পাখিই। বেশির ভাগ যায় অনাবৃষ্টির দেশে। চড়ুই পাখি দুটো কিন্তু দেশ ছাড়ে না। কারণ ঘনবৃষ্টির দেশে ঝড়-বৃষ্টিতে কষ্ট হলেও পেট ভরে খেতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া, এ মহাপতঙ্গ অনাবৃষ্টির দেশেও দেখা দিয়েছে। ওদের জনক স্বচক্ষে দেখেই গল্প বলেছিল। চড়ুই দম্পতি তুলো, পালক, শুকনো খড় ঠোঁটে করে ফোকরে এনে জমা করে। সাজিয়ে গুজিয়ে সেখানে নীড় রচনা করে। বাড়ির বাসিন্দা দোপেয়ে দৈত্য ওদের দেখে খুশি হয়। স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের ডেকে বলে, লক্ষণ শুভ। ঐ দেখো, চড়ুই পাখি বাসা বাঁধছে। এগুলো ভালো দেখে আসে, মন্দ দেখে চলে যায়। এ বছরটা সুখে-শান্তিতে কাটবে।

কিন্তু সুখে-শান্তিতে দিন কাটে না। বন্যায় দেশ ডুবে যায়। দিন দিন পানি বাড়তে থকে। বাড়ির মালিক দোপেয়ে দৈত্য এবং আর অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যায়। যারা যেতে পারে না, তারা প্রাণের দায়ে বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে, গাছের ডালে উঠে হা-হুতাশ করে। চড়ুই পাখি দুটোরও দুর্দশার অন্ত নেই। ওদের প্রতিবেশী চড়ুই পাখিগুলো অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু ওদের পালাবার উপায় নেই। বাসায় রয়েছে কলজের টুকরো দুটো কচি ছানা। ওদের ফেলে আর যাওয়া যায় না।

এমন দুঃসময়ে বোঁ-বোঁ আওয়াজ তুলে আসে এক মহাপতঙ্গ। চড়ুই দুটো উঁচু গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে বসে চেয়ে দেখে। মহাপতঙ্গাটা কয়েক পাক ঘুরে একটা জলা মাঠে নামে।

দোপেয়ে দৈত্যরা হৈ-হৈ শুরু করে দেয়। মহাপতটা সাঁতার কেটে একটা বড় বাড়ির ছাদে সিঁড়ির কাছে গিয়ে থামে। কী অবাক কাণ্ড! একটা দোপেয়ে দৈত্য মহাপতঙ্গের পেট থেকে বেরিয়ে আসে। তার আহ্বানে এক এক করে একপাল দোপেয়ে দৈত্য মহাপতঙ্গোর পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওটা এবার বোঁ-বোঁ ডাক দিতে দিতে আকাশে ওঠে। দুপাক ঘুরে সোজা সূর্যাস্তের দিকে চলে যায়। 

ঐ দিন আরও কয়েকবার মহাপতঙ্গ আসে। বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে, গাছের ডালে ছিল যেসব দোপেয়ে দৈত্য তাদের পেটে পুরে কোথায় উধাও হয়ে যায়। 

চড়ুই পাখি দুটোর বিস্ময়ের সীমা নেই। রাতে বাসায় বসে স্ত্রী চড়ুই বলে,

-দোপেয়ে দৈত্যরা তো যেমন তেমন টেটন নয়।

-হ্যা, জবর টেটন। পুরুষ চড়ুই বলে, ওরা মহাপতঙ্গকেও দেখছি পোষ মানিয়েছে।

-সত্যি, ওদের বুদ্ধি-কৌশলের তারিফ করতে হয়।

-কেন, মা? বুকের তলা থেকে নর-ছানাটা জিজ্ঞেস করে।

-হ্যাঁরে, হ্যাঁ। বড় হয়ে যখন বাইরে যাবি তখন দেখতে পাবি। হাম্বা-হাম্বা, ভ্যাঁ-ভোম্বল, ঘেঁউ পা-চাটা, কুক্কুরুত, প্যাঁক টৈটৈ, ম্যাও-খোক্কস, শুশুধর, চিহি-টগবগ আরও কত জীব-জানোয়ারকে যে ওরা পোষ মানিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

-এই হাম্বা-হাম্বার অবস্থা দেখে আমার হাসিও পায়, দুঃখও লাগে। পুরুষ চড়ুই বলে, বেচারাকে নানান কাজে খাটিয়ে তো মারেই, উপরন্তু ওর পেটের নিচের ঝুলেপড়া চামড়া টেনে টিপে সাদা রস বের করে করে দোপেয়ে দৈত্যরা নিজেদের গলা ভেজায়।

স্ত্রী চড়ুই হেসে বলে, আবার দেখো, বিরাটকায় শুশুধর, চিহি-টগবগ- ওদের পিঠে চড়ে কেমন মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়।

পোস্টটি শেয়ার করুন