টুনটুনি ও কুনোব্যাঙ
– চাকমা রূপকথা
অনেকদিন আগের কথা। পাহাড়ের ঢালে ঝরনার ধারে গর্তে থাকত এক কুনোব্যাঙ। তার পাশে শিমলতার ঘন ঝোপ। ঝোপের ধারে কুলগাছে বাসা বেঁধেছিল একটি টুনটুনি। ব্যাঙ আর পাখির মধ্যে খুব ভাব।
একদিন শহর থেকে ঘুরে এল কুনোব্যাঙ। শহর থেকে ফিরেই সে টুনটুনিকে ডাকল। বলল, ও টুনটুনি, শুনছ? শহরের লোকেরা বলছিল, আসছে শনিবার নাকি খুব ঝড় হবে।
ঝড়ের কথা শুনে টুনটুনি খুব ভয় পেল। এখন উপায়? ব্যাঙের মনে তেমন ভাবনা নেই । সে টুনটুনিকে বলল, আমার গর্ত আছে। ঝড় এলে গর্তে লুকাব। কিন্তু তোমার কী হবে?
কুনোব্যাঙ বানিয়ে বানিয়ে কথা বলত। ঝড়ের কথাও সে বানিয়ে বলেছিল। আসলে শহরে এ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। মিথ্যা বলে ভয় দেখানোই তার স্বভাব। টুনটুনি ছিল খুব ভীতু। ঝড়ের কথা শুনে ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল ।
শনিবার সকাল থেকে আকাশে মেঘ করেছে। এক সময় মেঘ ডেকে উঠল। ভয়ে টুনটুনির বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। ছুটতে ছুটতে সে গিয়ে বসল মস্ত বড় এক চিবিদ গাছের মগডালে । পাহাড়ের উঁচুতে চিবিদ গাছ ডালপালা মেলে আছে। সেই গাছে থাকত এক রংরাং পাখি । আগের দিনে চিবিদ গাছে রংরাং পাখিরা বাসা বাঁধত। রংরাং পাখিটা তখন গাছের ডালে বসে হাঁ করে হাওয়া খাচিছল।
টুনটুনি রংরাং পাখির ঠোঁটের সেই ফাঁকটিকে গর্ত ভেবে তার ভেতরে ঢুকে পড়ল ।
চমকে উঠল রংরাং পাখি। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল। ভয়ে টুনটুনি বাইরে বেরিয়ে এল।
গাছের নিচে ঘাস খেয়ে বেড়াচিছল এক হরিণ। রংরাং পাখির চিৎকারে ভয় পেয়ে সে দিল ভোঁ- দৌড়। বনের ধারে বিশ্রাম নিচ্ছিল এক মস্ত বড় অজগর সাপ। হরিণের খুর লাগল তার লেজে। লেজের ব্যথায় সে কোঁকাতে থাকল। তারপর মাথা তুলে সামনে দেখতে পেল এক পিঁপড়ের বাসা। অজগর পিঁপড়ের বাসায় দিল এক ধাক্কা। সেই ধাক্কায় পিঁপড়ের বাসা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল ।
পিঁপড়ের সর্দার ছিল বেজায় রাগী। সে রাগের মাথায় হাতির শুঁড়ে কুটুস করে এক কামড় বসিয়ে দিল। এক ঝাড় কলাগাছ খেয়ে হাতিটা তখন জিরিয়ে নিচ্ছিল। রেগেমেগে সে উঠে দাঁড়াল। পিঁপড়ে ততক্ষণে পালিয়েছে। পিঁপড়েকে ধরতে সে পা বাড়াল। সেখানকার চাষিরা পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ করত। হাতির সামনে পড়ল এক জুম খেত! সেই জুমে ধান বুনেছিল এক বুড়ি। বুড়ির ছেলেমেয়ে কেউ নেই। অনেক কষ্টে সে একা একা ধান বুনেছে। হাতিটা বুড়ির কষ্টের ফসল সাবাড় করতে শুরু করল। তা দেখে দুঃখে বুড়ি কেঁদেই ফেলল। সে বিচার চাইতে গেল রাজার কাছে।
বুড়ির কথা শুনে রাজা তো রেগে আগুন । তার রাজ্যে এত বড় অন্যায়? রাজা হাতিকে ডেকে পাঠালেন । রাজার হুকুম পেয়ে হাতি এল রাজ-দরবারে। রাজাকে সালাম করল শুঁড় তুলে। রাজা রেগে বললেন, হাতি, তোমার এত সাহস? তুমি বুড়ির জুম ধান সাবাড় করেছ? হাতি বলল, মহারাজ, এক পাজি পিঁপড়ে আমার শুঁড়ে কামড়ে দিয়েছে। আর তাই আমি রাগ করে বুড়ির ধান খেয়ে ফেলেছি। শুঁড়ের ব্যথায় মরছি। কাঁদতে গেলে চোখের পানিতে শুঁড় যায় ভিজে। তাই ভালো করে কাঁদতেও পারি না, মহারাজ।
রাজা মহাভাবনায় পড়লেন। ঠিকই তো শুঁড়ে ব্যথা হলে হাতির কি হুঁশ থাকে? রাজা হুংকার ছেড়ে বললেন, পিঁপড়েটাকে ডেকে পাঠাও। পিলপিল পায়ে পিঁপড়ে এসে হাজির হল। সে বলল, মহারাজ, আপনি কাটলেও কাটতে পারেন, মারলেও মারতে পারেন। আমার কোন কসুর নেই ।
রাজা পিঁপড়েকে ধমক দিয়ে বললেন, একটুকু জীব তুমি, তোমাকে কাটার জায়গা কোথায়? তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাব ।
পিঁপড়ে তখন ভয়ে ভয়ে বলল, অজগর আমার বাসা ভেঙে দিয়েছে। তাই আমি হাতির শুঁড় কামড়ে দিয়েছি।
রাজার হুকুমে কাটা লেজ নিয়ে হাজির হল অজগর । সে রাজাকে তার কাটা লেজটা দেখাল ।
লেজের দুঃখে সে পিঁপড়ের বাসা ভেঙে দিয়েছে। রাজাকে সে বলল, আপনার লেজ নেই। লেজের কষ্ট আপনি বুঝবেন কী করে?
নিজের লেজ নেই বলে মহারাজ লজ্জা পেলেন । হুংকার ছেড়ে বললেন, হরিণকে ডাক ।
হরিণ এল । রাজাকে কুর্নিশ করে বলল, মহারাজ, রংরাং পাখির কাণ্ড শুনুন । সে ভীষণ জোরে চিৎকার করছিল। আমি তাই ভয়ে দৌড়াতে থাকি। আমার খুর লেগে অজগরের লেজ কেটেছে, একথা বুঝতেই পারিনি ।
রাজার হুকুমে রংরাং পাখি তার বিরাট ডানা মেলে দরবারে এল। তারপর সে বলল, মহারাজ, ছোট্ট টুনটুনিটা আমার ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকে পড়ল। আর তাই আমি চমকে উঠে চিৎকার শুরু করি । দোষ কী আমার?
টুনটুনি এল। সে ভয়ে চুপসে গেল। কাঁচুমাচু করে সে বলল, মহারাজ, তখন আমি ভুল করে রংরাং পাখির মুখে ঢুকে পড়েছিলাম। কুনোব্যাঙ আমাকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে । রাজা টুনটুনিকে ধমক দিয়ে বললেন, আমার রাজ্যে ভয় কিসের?
রাজা মিথ্যা বলা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি মিথ্যাবাদী কুনোব্যাঙকে ডেকে পাঠালেন ।
কুনোব্যাঙ কি সহজে ধরা দেয়? রাজার আদেশ শুনে সে ঢুকে পড়ল গর্তে। রাজার পেয়াদা খুঁজে বের করল কুনোব্যাঙকে । পা ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল ।
কুনোব্যাঙকে দেখে রাজা বাজখাঁই গলায় বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। মিথ্যা বলা বড় অপরাধ । তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব ।
কুনোব্যাঙ নিজের দোষ স্বীকার করল। সে হাতজোড় করে রাজার কাছে ক্ষমা চাইল । আর কখনও সে মিথ্যা কথা বলবে না।
রাজার মনে দয়া হল। তিনি কুনোব্যাঙকে প্রাণে মারলেন না। তবে মিথ্যা বলার জন্য শাস্তি তাকে পেতেই হবে । কুনোব্যাঙকে তিনি পঁচিশ ঘা বেত মারার হুকুম দিলেন। রাজার হুকুমে কুনোব্যাঙকে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধা হল। তারপর পেয়াদা তাকে বেত মারতে শুরু করল। যতই বেত মারা হয় ব্যাঙ ততই ফুলতে তাকে। তার গা থেকে বেরিয়ে আসে সাদা সাদা আঠা। বেতের বাড়ি খেয়ে তার শরীর দাগে ভরে গেল। তারপর থেকে ব্যাঙের শরীরের চামড়া হল খসখসে। আর কাঁঠাল গাছ একটু কাটতেই বেরিয়ে আসে সাদা রঙের আঠা।






