টুনটুনি আর টুনটুনা – জসীম উদ্দীন

টুনটুনি পাখির গান তবু থামে না। তারা এ ডাল হইতে ও ডালে, ও ডাল হইতে এ ডালে আসে, রাজার মাথার উপর দিয়া ফুরুৎ ফুরুৎ করিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়–

“রাজার আছে যত টাকা,
মমাদের আছে তত টাকা।”

কি, এত বড় রাজদ্রোহী এই টুনটুনি পাখি! স্পর্ধা ত কম না! রাজাকে অপমান ! রাজা এবার রাগে জ্বলিয়া উঠিলেন।

“কে আছ, এখনই এই টুনটুনি পাখিকে বন্দী কর।” রাজার হুকুম পাইয়া শহর-কোতােয়াল হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন। সােয়ালক্ষ দারােগা, জমাদার কনস্টেবল, মার মার করিয়া উঠিলেন— সােয়ালক্ষ সিপাই সােয়ালক্ষ বন্দুক গুডুম করিয়া আওয়াজ করিলেন। সােয়ালক্ষ কামান কাঁধে করিয়া সােয়ালক্ষ গদাইলশকর হন হন করিয়া ছুটিল।

কিন্তু কামানের গুডুম আর টুনটুনি পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ বন্দুকের ফুটুৎ ফুটুৎ আর টুনটুনি পাখির সুরুৎ সুরুৎ কিছুতেই থামে না। এদিক হইতে যদি কামান গর্জায়, টুনটুনি পাখি ওদিকে চালিয়া যায়। ওদিক হইতে যদি বন্দুক ফটকায় টুনটুনি পাখি এদিকে চলিয়া আসে।

এতটুকুন দু’টি পাখি! গায়ে বন্দুকের গুলিও লাগে না, কামানের গােলা বারুদও আঘাত করে না। সােয়ালক্ষ দারােগা ওমাদার রােদে ঘমিয়া উঠিলেন। সােয়ালক্ষ গদাইলশকর দৌড়াইতে দৌড়াইতে হাপুস হুপুস হইয়া গেলেন ; কিন্তু টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিলেন না।

রাজা তখন রাগিয়া মাগিয়া অস্থির। প্রধান সেনাপতিকে ডাকিয়া কহিলেন, “যদি টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিয়া আনিতে পার, তবে তােমার গর্দান কাটিয়া ফেলিব!”

গর্দান কাটার ভয়ে প্রধান সেনাপতি বনের মধ্যে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন!

বনের মধ্যে ছিল এক কাঠুরিয়া । সে-ই প্রধান সেনাপতিকে পরামর্শ দিল, “বলি, সেনাপতি মহাশয়। কামান বন্দুক দিয়া টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিবেন না। জেলেকে ডাকিয়া বনের মধ্যে জাল ফেলিতে বলুন। সেই জালে টুনটুনি পাখি ধরা পড়িবে ।”

কাঠুরিয়ার কথা শুনিয়া প্রধান সেনাপতি জেলেকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সােয়ালক্ষ নাতিপুতি লইয়া জেলে আসিয়া সমস্ত বন জুড়িয়া জাল পাতিল । সেই জালে টুনটুনি আর টুনটুনা ধরা পড়িল । টুনটুনি আর টুনটুনাকে হাতে পাইয়া রাজা ঘরে চলিলেন।

রাজার একশ এক রানী। পিলে রানী, জ্বরাে রানী, কেশাে রানী, বেতাে রানী, মােটা রানী, পাতলা রানী, খোড়া রানী, তােতলা রানী, কানা রানী, বােবা রানী, আলসে রানী, চটপটে রানী, দুষ্টু রানী, মিষ্টি রানী, কত রানীর নাম আর করিব ? সব রানীরা আসিয়া রাজাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। কেহ খোড়াইতে খোড়াইতে আসিল, কেহ জুরে কাঁপিতে কাঁপিতে আসিল, কেহ আলসি ভাঙিতে ভাঙিতে ভাসিল, কেহ চটপট করিয়া আসিল, কেহ ঘুমে ঢুলিতে ঢুলিতে আসিল, সবাই আসিয়া রাজাকে ধরিল,

“মহারাজ আজ শিকারে যাইয়া কি আনিলেন ?” রাজা বলিলেন, আজ শিকারে যাইয়া টুনটুনি আর টুনটুনা পাখি ধরিয়া আনিয়াছি।” তখন পিলে রানী পিলের ভরে কেঁাকাইতে কোকাইতে বলিলেন, “দেখি ত কেমন টুনটুনি পাখি ?”

রাজা পিলে রানীর হাতে পাখি দু’টি দিয়া রাজসভায় যাইয়া এই রাজদ্রোহী পাখি দু’টির বিচারের বন্দোবস্ত করিতে মনােযােগ দিলেন।

এদিকে পিলে রানীর হাত হইতে টুনটুনি পাখি গেল জ্বরাে রানীর হাতে, তার হাত হইতে গেল কেশাে রানীর হাতে, তারপর এর হাতে ওর হাতে নানা হাতে ঘুরিতে ঘুরিতে টুনটুনি পাখি যখন আলসে রানীর হাতে আসিল, অমনি টুনটুনি করিল ফুরুৎ ফুরুৎ, টুনটুনা করিল সুরুৎ সুরুৎ! দুইজন দুই দিকে পালাইল। রাজার একশ এক রানী ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।

পরদিন রাজা রাজসভায় বসিয়া আছেন ; কাশী, কাঞ্চি, কনােজ নানান দেশ হইতে পণ্ডিতেরা আসিয়াছেন রাজদ্রোহী টুনটুনি আর টুনটুনা পাখির বিচার করিতে। রাজসভায় পাখিদের ডাক পড়িল। শামুকের কৌটা হইতে নস্য নাকে পুরিয়া, বড় বড় কেতাব উল্টাইয়া, পাল্টাইয়া পণ্ডিতেরা রাজদ্রোহী পাখির কি শাস্তি হইতে পারে তাই বাহির করিতে ব্যস্ত ; কিন্তু টুনটুনা আর টুনটুনি পাখি আসে না। রাজা রাগিয়া মাগিয়া রাজসভা ছাড়িয়া রানীদের মধ্যে যাইয়া উপস্থিত। “কোথায় সেই রাজদ্রোহী পাখি দু’টি ?” তখন এ রানী চায় ও রানীর মুখের দিকে, ও রানী চায় সে রানীর মুখের দিকে। রাজার মাথার উপর তখন টুনটুনি পাখি উড়িয়া চলিয়াছে ফুরুৎ ফুরুৎ। রাজা সবই বুঝিতে পারিলেন। রাগিয়া মাগিয়া রাজা তখন একশ এক রানীর নাক কাটিয়া ফেলিলেন।

টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রজার মাথার উপর দিয়া ফুরুৎ ফুরুৎ ওড়ে, আর গান গায়—

“রাজার আছে যত টাকা,
মমাদের আছে তত টাকা।”

কি, এত বড় বুকের পাটা টুনটুনি পাখির! রাজার কুলের কথা লইয়া ছড়া কাটে! ধর টুনটুনি পাখিকে। জেলে আবার তার সােয়ালক্ষ নাতিপুতি লইয়া রাজবাড়িতে হাজির ; পাখি দু’টি জালে ধরা পড়িল। রাজা তাহাদের হাতে পাইয়া কলাপাতার মতাে কাঁপিতে লাগিলেন। এবার আর বিচার-আচারের প্রয়ােজন নাই। এক গ্লাস পানি লইয়া রাজা পাখি দু’টিকে গিলিয়া খাইয়া ফেলিলেন।

তখন রাজসভায় বড় বড় পণ্ডিত বড় বড় কেতাব দেখিয়া মাথা নাড়িলেন। তাহাদের মাথানাড়া দেখিয়া মন্ত্রী মহাশয় ভাবিত হইলেন। পণ্ডিতেরা মন্ত্রী মহাশয়কে সাবধান করিয়া দিলেন, “মহারাজ যদি কোন মুহূর্তে হাসিয়া উঠেন, তবে পাখি দুটি রাজার হাসিমুখের ফাক দিয়া বাহির হইয়া আসিবে।”

মন্ত্রী মহাশয় সেয়ান লােক। তিনি খাড়া তলােয়ার হাতে দুই সেপাইকে রাজার দুই পাশে দাঁড় করাইয়া দিলেন। যদিবা রাজা মহাশয় হাসিয়া ফেলেন, আর সেই ফাঁকে টুনটুনি পাখিরা বাহির হইয়া আসিতে চায় ; তখনি তারা তলােয়ার দিয়া মারিবে কোপ, রাজার দুই পাশ হইতে দুই টুনটুনি পাখির ঘাড়ে।।

খােকাখুকুরা, তােমরা কেহ হাসিও না যেন! কেউ হাসিও না। একি হাসিয়া দিলে যে ? তােমাদের সঙ্গে সঙ্গে রাজা মহাশয়ও যে হাসিয়া উঠিলেন! সেই হাসির ফাঁকে টুনটুনি আর টুনটুনা ফুরুৎ করিয়া উড়িয়া পালাইল। রাজার দুইধার হইতে দুই সেপাই তলােয়ার উঠাইয়া মারিল কোপ। টুনটুনির গায় ত লাগিল না। লাগিল রাজা মহাশয়ের নাকে। নাক কাটিয়া দুইখান ।

টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রাজা মহাশয়ের মাথার উপর দিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়

“আমি– টুনটুনা টুনটুনাইলাম
রাজা মশাইর নাক কাটাইলাম
নাক কাটাইলাম।”


পোস্টটি শেয়ার করুন