চরু – হাসান আজিজুল হক
ন্যাংটা ছেলেটা এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে গলায় চুমু খায়।
এমনি করে কতদিন কেটে গেল। দুবার আমগাছে মুকুল এলো। চরুর গায়ের ফ্যাকাশে সাদা রং বদলে গিয়ে তার জায়গায় ঘন বাদামি রং দেখা দিল, আর দেখা দিল সাদা সাদা বুটি। একজোড়া ডালপালাঅলা শিং গজালো মাথায়। ফরসা ছেলেটাও এখন একটু বড় হয়েছে, সে আর ন্যাংটা থাকে না, একটা প্যান্ট পরে শুধু। বাড়ির বাবরিচুল হিংসুটে চোখ-অলা লোকটা আবার একদিন বিরাট একটা হরিণ কাঁধে নিয়ে বাড়ি এলো। এত বড় হরিণ, তাকে বয়ে আনতে লোকটার শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। তার পিঠ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়াচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হরিণটার মাংসের টুকরোয় দুটো ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেল। বাড়ির একজন এসে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, মাংস কতটা হবে? বাবরিচুল লোকটা বলল, মণখানেক হতি পারে। অন্য লোকটা বলল, দশ টাকা স্যারের নিচে বেচা যাবে না।
দুজনে মাংসের ঝুড়ি দুটো মাথায় নিয়ে গাঁয়ের ভেতরে চলে গেল। পড়ে রইল হরিণটার বিরাট চামড়া আর তার শিং-অলা মুন্ডুর দুটি নীল চোখের স্থির চাউনি।
এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যের সময় বাড়ির সবচেয়ে বড় ভাই রোগা চিমসে লোভী লোকটা বলল, বাড়ির হরিণটাকে আর রেখে লাভ কী হবে। শুধু শুধু খাওয়ানো খালি। আর যেরকম শিং হইছে, কোনদিন কাকে খুন করবে। ওর মাংস কতটা হতি পারে? বাবরিচুল লোকটা বলল, মণদেড়েক হতি পারে।
তালি কাল ওটাকে জবাই দিয়ে দে।
সকাল হচ্ছে। দাওয়ায় ঘেরা জায়গাটার ভেতর চরু এতোক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঝিমুচ্ছিল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো আসতেই সে উঠে বসল। এক কোণে কালকের খানিকটা ঘাস ছিল। সে ঘাস চিবোতে লাগল চরু। দেখতে দেখতে বেড়ার ফুটো দিয়ে এইরকম চুলের মতো সরু সরু সূর্যের আলোর সূতো ঢুকে পড়ল চরুর অন্ধকারে ঘরের মধ্যে। তখুনি তার কানে এল বালিতে ছুরির ফলা ঘষার ঘষ ঘষ আওয়াজ। তারই জন্যে ছুরি শানানো হচ্ছে। চরু জানে না তার মাংস মানুষের কত প্রিয়!
আপনমনে ঘাস চিবোতে চিবোতে হঠাৎ সে দেখতে পেল দাওয়ার বাইরের দিকের বেড়া একটু একটু করে ফাঁক হচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল বেড়াটা, আর ঘরে ঢুকল ফরসা বোবা-কালা ছেলেটা। আঁকড়ে ধরল সে চরুর গলা, আর হু হু করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু দেরি করল না সে, খুঁটিতে বাঁধা চরুর দড়িটা খুলে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়ে চরুকে নিয়ে সে ভাঙা বেড়ার তলা দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল। তারপর ছুট, ছুট! চরুর তো মজাই! লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে গাঁয়ের বাড়িঘর পার হয়ে ওরা এসে পড়ল খালের ধারে। সেখানে একটা ছোট্ট নৌকা বাঁধা। ছেলেটা চরুকে ঠেলে সেই নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসল। তার পরেই ছেড়ে দিল নৌকা।
খালের মাঝ বরাবর এসেছে, এইসময় পেছনে বহু লোকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। মানুষের একটা দল ছুটে আসছে। সকলের আগে ছুটে আসছে বাবরি চুল-অলা হিংসুটে লোকটা। হাতে ছুরি। ছুরির ফলাটা সকালের আলোয় ঝকঝক করছে। তার পেছনে হায় হায় করতে করতে আসছে বাড়ির বড়ভাই রোগা চিমসে লোকটা। সবাই চিৎকার করে ডাকছে ছেলেটাকে, তাকে ফিরে আসতে বলছে চরুকে নিয়ে। এদিকে ছেলেটা বসে আছে ওদের দিকে পিছন ফিরে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে। শুনতেও পাচ্ছে না কোনো কথা। খালের ওপারে পৌঁছে গেল নৌকা। ঠিক সেইখানে, যেখানে চরু একদিন সকালে ঘাস খাচ্ছিল আর মরা মাকে দেখতে পেয়েছিল ঝোপের ধারে। যেখান থেকে জালে করে বেঁধে এনেছিল তাকে। নৌকা থামতেই ছেলেটা কাদার মধ্যে লাফিয়ে নেমে দড়িতে টান দিয়ে চরুকে নামালো। সূর্যের আলো পড়েছে ছেলেটার মুখে। চরুর গলাটা জড়িয়ে ধরল সে, অনেকবার চুমু খেল তার গলায়। নাকের সর্দিমেশা চোখের পানি মুছল তার ঘাড়ের লোমে, তারপর গলা থেকে দড়ি খুলে নিয়ে উস্ উস্ করে বিকট আওয়াজ বের করল গলা থেকে।
একটা লাফ দিয়ে চরু উঠে গেল ঢালু ঘাসজমিটায়। একবার ফিরে তাকালো সে। ছেলেটার কদাকার ভেজা মুখে আলো পড়েছে। একটু একটু করে হাসি ফুটে উঠল সেই মুখে। তখন কী সুন্দর দেখাচ্ছে সেই মুখ!
চরু আর ফিরে দেখল না। বড় বড় লাফ দিয়ে সে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল।
[ঈষৎ সংক্ষেপিত]