গুরুচন্ডালী – শিবরাম চক্রবর্তী
দীপক বলে, ‘সমাসীন হইল’ও বলা যায়।
‘আবার তুই এর মধ্যে সমাস এনে ঢোকাচিছস?’ গণেশ তার কানের গোড়ায় ফিসফিস করে, ‘এতেই কেঁদে কূল পাইনে, এর ওপর ফের সমাস?’
‘যেমন উদাহরণস্বরূপ-’ সীতানাথবাবু বলতে থাকেন… কিন্তু তাঁর বলার মাঝখানেই পিরিয়ডের ঘণ্টা বেজে যায়। উদাহরণস্বরূপ প্রকাশের আগেই তাঁকে ক্লাস ছেড়ে যেতে হয়।
নিজের বক্তব্য আরেক দিনের জন্যে রেখে সমস্ত প্রশ্নটাই আমূল মূলতবি করে যান।
দিনকয়েক পরে গণেশ রেশন আনতে গিয়ে দেখল যে, সেকেন্ড পন্ডিত মশাইও সেই সরকারি দোকানে এসেছেন। লম্বা লাইনের ফাঁকে সীতানাথবাবুও দাঁড়িয়ে। সেই কিউয়ের ভেতর মহল্লার ঝাড়ূদার-নিশ্চয়ই সেখানে চন্ডাল-যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পাড়ার গুন্ডারা। তারাও কিছু সাধু নয়। গুরুতর লোক। তাদের প্রচন্ডালই বলা যায় বরং। প্রচন্ড তাদের দাপট। পাড়ার সার এবং অসার-সবাই এক সারের মধ্যে খাড়া। একেবারে সমান সমান। রীতিমতোই গুরুচন্ডালী। সীতানাথবাবু ছিলেন সারির মাঝামাঝি। গণেশ অনেক পরে এসে শেষের দিকে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সীতানাথবাবুকে। চন্ডালদের মধ্যে গুরুদেব-ব্যাকরণ বিরুদ্ধ এই অভাবিত মিলনদৃশ্য দেখে সে অবাক হলো। সত্যি বলতে সে-দৃশ্য অবাক হয়ে দেখবার মতোই।
সীতানাথবাবুর দৃষ্টি কোনোদিকে ছিল না। অজগরের মতো বিরাট লাইন যেন কচছপের গতিতে একপা- এক-পা করে এগুচ্ছে। কতক্ষণে রেশন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন, হাঁড়ি চড়িয়ে চান সেরে নাকে-মুখে দুটি গুঁজে পাড়ি দেবেন স্কুলে, সেই ভাবনাতেই সমস্ত মন পড়েছিল তাঁর।
সহসা এক বালকসুলভ তীক্ষ্ণকণ্ঠ তাঁর কানে এসে পিন ফোটাল। ফুটতেই তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন-‘স্যার, স্যার ! ব্যগ্র হোন কল্য।’ ‘ব্যগ্র হোন কল্য?’ শুনতে পেলেন তিনি। শুনেই তিনি পিছন ফিরে তাকালেন। দেখতে পেলেন গণেশকে। কিউয়ের শেষে দাঁড়িয়ে চিৎকার ছাড়ছে : ‘ব্যগ্র হোন কল্য।’
তার মানে? কেন তিনি ব্যগ্র হবেন? আর হন যদিবা তো তা কালকে কেন? ব্যগ্র যদি হতেই হয় তো আজকেই কেন নয়? এই মুহূর্তেই বা নয় কেন? আর, এই মুহূর্তে ব্যগ্র হয়েই বা কী হবে? কিউয়ের লাইন তো আর ছেলেদের খাতার লাইন নয় যে পেনসিলের এক খোঁচায় ফ্যাঁশ করে কেটে এগিয়ে যাবেন! যত তাড়াই থাক, যতই ব্যগ্র হন, আগের লোকদের কাটিয়ে এগুবার একটুও উপায় নেই এখানে। ফাঁড়ার মতোই অকাট্য এই লাইন। ফাঁড়ির মতোই ভয়াবহ।
‘স্যার স্যার-পুনরায়! পুনরায়! ব্যগ্র হোন কল্য! ব্যগ্র হোন কল্য!’ আবার সেই আর্তনাদ। সীতানাথবাবুর ইচ্ছে করে এক্ষুনি গিয়ে বেশ একটু ব্যগ্রভাবেই গণেশের কানদুটো ধরে মলে দেন আচ্ছা করে। বেশ করে মলে দিয়ে বলেন, ‘এই মললাম অদ্য। ফের মলব কল্য।’ কিংবা তুলে ধরে এক আছাড় মারেন ওকে। কিন্তু ওকে পাকড়াবার এই ব্যগ্রতা দেখাতে গিয়ে লাইনের জায়গা পা-ছাড়া করার কোনো মানে হয় না।
আস্তে-আস্তে এগিয়ে দোকানের ভেতর পৌঁছে রেশনের দাম দিতে গিয়ে তাঁর চোখ কপালের কানায় ঠেকল – যেমন একটু আগে তাঁর কান চোখা হয়ে উঠেছিল। দ্যাখেন যে তাঁর পকেট মারা গেছে। পকেটের যেখানে টাকার ব্যাগটা থাকে, সেখানটা ফাঁকা। বৃথা হইচই না করে বিমুখে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন।
‘স্যার, তখন আমি কী বলছিলাম? আমি অত করে বললাম, তা আপনি কানই দিলেন না। আদৌ কর্ণপাতই করলেন না !’ গণেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। দোকানের মুখে পৌঁছে মাস্টারের সম্মুখে পড়েছে। ‘কী বলেছিলে তুমি? তুমি তো আমায় কাল ব্যগ্র হতে বলেছিলে? আর এদিকে আমার আজ সর্বনাশ হয়ে গেল!’
‘কাল ব্যগ্র হতে বলেছি? মোটেই না। আমি বলেছিলাম আপনার ‘ব্যগ্র গ্রহণ করল’। আপনার পরেই যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে হতভাগাই পেছন থেকে আপনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে-’
‘তা, ‘পকেট মারল’ বলতে তোর কী হয়েছিল রে হতমুখ্য?’ সীতানাথবাবুর সমস্ত রাগ এখন গণেশের ওপর গিয়ে পড়ে : ‘সোজাসুজি তা বললে কী হতো? তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো তোর? ‘পকেট মারছে সার’- বলতে কী আটকাচিছল তোমার পাপমুখে?’
‘ছি-ছি গণেশ!’ নিজের জিভ কাটে-‘অমন কথা বলবেন না স্যার! ‘পকেট মারছে’-সে কথা কি আপনার সামনে উচ্চারণ করতে পারি? পকেট প্রহার করছে বললেও তো শুদ্ধ হয় না। আর বলুন, গুরুমশায়ের সামনে অমন চন্ডালের মতন ভাষা কী বলতে আছে-বলা যায় কী? ও কথা-অমন কথা বলবেন না স্যার। ব্যগ্র গ্রহণ করল বলেছি-জানি যে, তাও সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়নি, গুরুচন্ডালী একটুখানি যেন রয়ে গেছে; ভাবলাম, কতবার ভাবলাম, কিন্তু কী করব, ব্যাগের সাধুভাষা যে কী তা তো আমার জানা নেই স্যার। কিন্তু কিছুতেই ব্যাগের শুদ্ধটা মগজে এল না। এদিকে ভাবতে-ভাবতে ব্যাগসুদ্ধ নিয়ে সে যে সটকাল!’