ক্ষীরের পুতুল – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দাসীরা সেই বাসি মুক্তোর হার এক জাহাজ রুপো নিয়ে বাজারে বেচে আসে।

রাজা এক জাহাজ রুপো দিয়ে সুওরানীর গলায় দিতে সেই মুক্তোর এক ছড়া হার কিনলেন।

তারপর মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর হার গাঁথিয়ে, ছ’মাস পরে রাজা এক দেশে এলেন। সে দেশে রাজকন্যের উপবনে নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত মণির পাতা খেয়ে, জলের মতো চিকন, বাতাসের মতো ফুরফুরে, আকাশের মতো নীল রেশমের গুটি বাঁধে। রাজার মেয়ে সারা রাত ছাদে বসে, আকাশের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে, সেই নীল রেশমে শাড়ি বোনেন। একখানি শাড়ি বুনতে ছ’মাস যায়। রাজকন্যে একটি দিন সেই আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পরে শিবের মন্দিরে মহাদেব নীলকণ্ঠের পূজা করেন। ঘরে এসে শাড়ি ছেড়ে দেন, দাসীরা যার কাছে সাত জাহাজ সোনা পায় তার কাছে শাড়ি বেচে। রাজা সাত জাহাজ সোনা দিয়ে আদরিনী সুওরাণীর শখের শাড়ি কিনলেন।

তারপর আর ছ’মাসে রাজার সাতখানা জাহাজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ছোটোরানীর মানিকের চুড়ি, সোনার মল, মুক্তোর মালা, সাধের শাড়ি নিয়ে দেশে এল। তখন রাজার মনে পড়ল বড়োরানী বাঁদর চেয়েছেন।

রাজা মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রীবর, বড়ো ভুল হয়েছে। বড়োরানীর বাঁদর আনা হয়নি, তুমি একটা বাঁদরের সন্ধানে যাও।

রাজমন্ত্রী একটা বাঁদরের সন্ধানে চলে গেলেন। আর রাজা শ্বেতহস্তী চড়ে লোকারণ্য রাজপথ দিয়ে, ছোটোরানীর সাধের গহনা শখের শাড়ি নিয়ে অন্তঃপুরে চলে গেলেন।

ছোটোরানী সাত-মহল বাড়ির সাত-তলার উপরে সোনার আয়না সামনে রেখে, সোনার কাঁকুইয়ে চুল চিরে, সোনার কাঁটা সোনার দড়ি দিয়ে খোঁপা বেঁধে সোনার চেয়াড়িতে সিঁদুর নিয়ে ভুরুর মাঝে টিপ পরছেন, কাজল-লতায় কাজল পেড়ে চোখের পাতায় কাজল পরছেন, রাঙা পায়ে আলতা দিচ্ছেন, সখীরা ফুলের থালা নিয়ে, পানের বাটা নিয়ে রাজরানী ছোটোরানীর সেবা করছে— রাজা সেখানে এলেন।

স্ফটিকের সিংহাসনে রানীর পাশে বসে বললেন— এই নাও, রানী! মানিকের দেশে মানিকের ঘাট, মানিকের বাট— সেখান থেকে হাতের চুড়ি এনেছি। সোনার দেশে সোনার ধুলো, সোনার বালি— সেখান থেকে পায়ের মল এনেছি। মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, দুটি পাখি মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সেই মুক্তোর হার গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, ভোরের বেলায় ফেলে দেন। রানী, তোমার জন্যে সেই মুক্তোর হার এনেছি। রানী, এক দেশে রাজার মেয়ে, এক-খী রেশমে সাত-খী সুতো কেটে নিশুতি রাতে ছাদে বসে ছ’টি মাসে একখানি শাড়ি বোনেন, এক দিন পরে পুজো করেন, ঘরে এসে ছেড়ে দেন। রানী, আমি সেই রাজার মেয়ের দেশ থেকে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে রাজকন্যার হাতে বোনা শাড়ি এনেছি। তুমি একবার চেয়ে দেখ! পৃথিবী খুঁজে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, একবার পরে দেখ!

রানী তখন দু’হাতে আটগাছা চুড়ি পরলেন; মানিকের চুড়ি রানীর হাতে ঢিলে হল, হাতের চুড়ি কাঁধে উঠল।

রানী তখন দু’পায়ে দশ-গাছা মল পরলেন; রাঙা পায়ে সোনার মল আল্‌গা হল, দু’পা যেতে দশ গাছা মল শানের উপর খসে পড়ল। রানী মুখ ভার করে মুক্তোর হার গলায় পরলেন; মুক্তোর দেশের মুক্তোর হার রানীর গলায় খাটো হল, হার পরতে গলার মাস কেটে গেল। রানী ব্যথা পেলেন।

সাত-পুরু করে শখের শাড়ি অঙ্গে পরলেন; নীল রেশমের নীল শাড়ি হাতে বহরে কম পড়ল। রানীর চোখে জল এল।

তখন মানিনী ছোটোরানী আট হাজার মানিকের আটগাছা চুড়ি খুলে ফেলে, নিরেট সোনার দশগাছা মল পায়ে ঠেলে, মুক্তোর মালা শখের শাড়ি ধুলোয় ফেলে বললেন— ছাই গহনা! ছাই এ শাড়ি! কোন্ পথের কাঁকর কুড়িয়ে এ চুড়ি গড়ালে? মহারাজ, কোন্ দেশের ধুলো বালিতে এ মল গড়ালে? ছি ছি, এ কার বাসি মুক্তোর বাসি হার! এ কোন্ রাজকন্যার পরা শাড়ি! দেখলে যে ঘৃণা আসে, পরতে যে লজ্জা হয়! নিয়ে যাও মহারাজ, এ পরা শাড়ি পরা-গহনায় আমার কাজ নেই।

রানী অভিমানে গোসা-ঘরে খিল দিলেন। আর রাজা মলিনমুখে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে কেনা সেই সাধের গহনা, শখের শাড়ি নিয়ে রাজসভায় এলেন।

রাজমন্ত্রী রাজসিংহাসনের এক পাশে, রাজ্যের মাঠ-ঘাট দোকানপাট সন্ধান করে, যাদুকরের দেশের এক বণিকের জাহাজ থেকে, কানা-কড়ি দিয়ে একটি বাঁদরছানা কিনে বসে আছেন।

রাজা এসে বললেন— মন্ত্রীবর, আশ্চর্য হলুম! মাপ দিয়ে ছোটোরানীর গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, সে শাড়ি, সে গহনা, রানীর গায়ে হল না!

তখন সেই বনের বানর রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে—বড়ো ভাগ্যবতী পুণ্যবতী না হলে দেবকন্যের হাতে বোনা, নাগকন্যের হাতে গাঁথা, মায়া-রাজ্যের এ মায়া-গহনা, মায়া-শাড়ি, পরতে পায় না। মহারাজ, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ, যাকে বৌ করবে তাকে পরতে দিও।

বানরের কথায় রাজা অবাক হলেন। হাসতে হাসতে মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রী বানরটা বলে কি? ছেলেই হল না, বৌ আনব কেমন করে? মন্ত্রী, তুমি স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়তে দাওগে, তাঁতির তাঁতে রানীর শাড়ি বুনতে দাওগে। এ গহনা, এ শাড়ি, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ; যদি বৌ ঘরে আনি তাকে পরতে দেব। রাজমন্ত্রী স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়াতে গেলেন। আর, রাজা সেই বাঁদর-কোলে বড়োরানীব কাছে গেলেন।

দুঃখিনী বড়োরানী, জীর্ণ আঁচলে পা মুছিয়ে, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় রাজাকে বসতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— মহারাজ, বোসো। আমার এই ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বোসো। আমার আর কী আছে তোমায় বসতে দেব? হায়, মহারাজ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে, আমি এমনি অভাগিনী তোমার জন্যে ছেঁড়া কাঁথা পেতে দিলুম।

রানীর কথায় রাজার চোখে জল এল। ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বসে বড়োবানীর কোলে বাঁদর-ছানা দিয়ে বললেন— মহারানী, তোমার এ ছেঁড়া কাঁথা ভাঙা ঘর, ছোটোরানীর সোনার সিংহাসন, সোনার ঘরের চেয়ে লক্ষগুণে ভালো। তোমার এ ভাঙা ঘরে আদর আছে, যত্ন আছে, দুটো মিষ্টি কথা আছে; সেখানে তা তো নেই। রানী, সাত জাহাজ সোনা দিয়ে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি দিয়েছি, ছোটোরানী পায়ে ঠেলেছে; আর কানাকড়ি দিয়ে তোমার বাঁদর এনেছি, তুমি আদর করে কোলে নিয়েছ। রানী, আমি আর তোমায় দুঃখ দেব না। এখন বিদায় দাও, আমি আবার আসব রানী। কিন্তু দেখো, ছোটোরানী যেন জানতে না-পারে! তোমার কাছে এসেছি শুনলে আর রক্ষে রাখবে না! হয় তোমায়, নয়তো আমায়, বিষ খাওয়াবে।

এমনি করে রাত কাটল। ছোটোরানীর সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, রাজার পাশে রাত কাটল; আর বড়োরানীর জলে ঝড়ে, ভাঙা ঘরে, ছেঁড়া কাঁথায় রাত কাটল।

সকাল হল। রাজবাড়িতে প্রহরীখানায় প্রহর বাজল, নাকরাখানায় নবৎ বাজল, রাজারানীর ঘুম ভাঙল।

রাজা সোনার ভৃঙ্গারে স্ফটিকজলে মুখ ধুয়ে, রাজবেশ অঙ্গে পরে, রাজ-দরবারে নেবে গেলেন। আর ছোটোরানী সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, ফুলের পাখায় হাওয়া খেতে খেতে পাশ ফিরে ঘুম গেলেন।

আর বড়োরানী কী করলেন?

ভাঙা ঘরে সোনার রোদ মুখে পড়ল, রানী উঠে বসলেন। এদিক দেখলেন ওদিক দেখলেন, এপাশ দেখলেন, ওপাশ দেখলেন— বানর নেই! রানী এ-ঘর খুঁজলেন ও-ঘর খুঁজলেন ঘরের চাল খুঁজলেন, গাছের ডাল খুঁজলেন— বানর নেই! বড়োবানী কাঁদতে লাগলেন।

বানর কোথা গেল?

বানর ভাঙা ঘরে ঘুমন্ত রানীকে একলা রেখে রাত না-পোহাতে রাজ-দরবারে চলে গেল।

রাজা বার দিয়ে দরবারে বসেছেন। চারিদিকে সভাসদ মন্ত্রী, দুয়ারে সিপাই-সান্ত্রী, আশে-পাশে লোকের ভিড়। রানীর বানর সেই লোকের ভিড় ঠেলে, সিপাই-সান্ত্রীর হাত এড়িয়ে, রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে— মহারাজ, বড়ো সুখবর এনেছি, মায়ের আমার ছেলে হবে।

পোস্টটি শেয়ার করুন