তখন নাপিত চারিদিকে চেয়ে চুপিচুপি বললে –
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।।’
এই কথা বলতেই নাপিতের ফোলা পেট একেবারে কমে আগেকার মতাে হয়ে গেল, বেচারা বড়ই আরাম পেল, এক আরামের নিঃশ্বাস ফেলে মনের ফুর্তিতে রাজবাড়িতে ফিরে চলল।.
নাপিত চলে গেলে বিদেশী এক ঢুলি সেই গাছের তলায় এল। এসে দেখলে গাছটা যেন আস্তে দুলছে, তার সমস্ত পাতা থরথর করে কাঁপছে, সমস্ত ডাল মড়মড় করছে – আর মাঝে মাঝে বলছে-
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।।’
ঢুলি ভাবলে এ তাে বড়াে মজার গাছ! এরই কাঠ দিয়ে একটা ঢােল তৈরি করি। এই বলে একখানা কুড়ল নিয়ে সেই গাছ কাটতে আরম্ভ করলে।
গাছ বললে – ‘টুলি, ঢুলি আমায় কাটিসনে!’
-আর কাটিসনে! এক-দুই-তিন কোপে একটা ডাল কেটে নিয়ে ঢােল তৈরি করে রাজার কান কাটা, তাই নিলে কাক ব্যাটা’ বাজাতে বাজাতে ঢুলি কানকাটা শহরের দিকে চলে গেল।
এদিকে কানকাটা শহরে রাজা কান হারিয়ে মলিন মুখে বসে আছেন আর নাপিতকে বলছেন – ‘নাপিত ভায়া এ কথা যেন প্রকাশ না হয়!’ নাপিত বলছে – ‘মহারাজ কার মাথায় দুটো কান যে এ কথা প্রকাশ করবে!’ এমন সময় রাস্তায় ঢোল বেজে উঠল –
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।।’
রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে নাপিতের চুলের মুঠি এক হাতে আর অন্য হাতে খাপ-খােলা তরােয়াল ধরে বললেন- ‘তবে রে পাজি! তুই নাকি এ কথা প্রকাশ করিসনি? শােন্ দেখি ঢেলে কী বাজছে।’ নাপিত শুনলে ঢােলে বাজছে-
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।।’
নাপিত কাঁদতে কাঁদতে বললে- ‘দোহাই মহারাজ, এ কথা আমি কাউকে বলিনি, কেবল বনের ভিতর গাছকে বলেছি। নইলে হুজুর পেটটা ফেটে মরে যেতুম! আর আমি মরে গেলে আপনার দাড়ি কে কামিয়ে দিত বলুন?’
রাজা বললেন- ‘চল্ ব্যাটা গাছের কাছে।’ বলে নাপিতকে নিয়ে রাজা মুড়িসুড়ি দিয়ে গাছের কাছে গেলেন। নাপিত বললে– ‘গাছ আমি তােমায় কী বলেছি? সত্য কথা বলবে।
গাছ বললে —
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।।’
রাজা বললেন – ‘আর কারাে কাছে নাপিত বলেছে কি?’
গাছ বললে – ‘না।’
রাজা বললেন – ‘তবে ঢুলি জানলে কেমন করে?’
গাছ বললে – ‘আমার ডাল কেটে ঢুলি ঢােল করেছে। তাই ঢােল বাজছে – ‘রাজার কান কাটা।’ আমি তাকে অনেকবার ডাল কাটতে বারণ করেছিলাম কিন্তু সে শােনেনি।’
রাজা বললেন – ‘গাছ, এ দোষ তােমার ; আমি তােমায় কেটে উনুনে পােড়াব।’
গাছ বললে – ‘মহারাজ, এমন কাজ কর না। সেই টুলি আমার ডাল কেটেছে, আমি তাকে শাস্তি দেব। তুমি কাল সকালে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এস।’
রাজা বললেন – ‘আমার কাটা কানের কথা প্রকাশ হল তার উপায়? প্রজারা যে আমার রাজত্ব কেড়ে নেবে।’
গাছ বলে — ‘সে ভয় নেই, আমি কাল তােমার কাটা কান জোড়া দেব। শুনে রাজা খুশি হয়ে রাজ্যে ফিরলেন।’
রাজা ফিরে আসতেই রাজার রানী, রাজার মন্ত্রী, রাজার যত প্রজা রাজাকে ঘিরে বললে — ‘রাজামশাই তােমার কান দেখি’। রাজা দেখালেন – এক কান কাটা। তখন কেউ বললে, – ‘ছি ছি’, কেউ বললে – ‘হায় হায়’। কেউ বললে, – ‘এমন রাজার প্রজা হব না।’ তখন রাজা বললেন, ‘বাছারা কাল আমার কাটা-কান জোড়া যাবে, তােমরা এখন সেই টুলিকে বন্দী কর। কাল সকালে তাকে নিয়ে বনে যে অশ্বত্থ গাছে তারই তলায় যেও।’ রাজার কথা শুনে প্রজারা সেই টুলিকে বন্দী করবার জন্যে ছুটল।
তার পরদিন সকালে রাজা মন্ত্রী নাপিত, রাজ্যের প্রজা আর সেই টুলিকে নিয়ে ধুমধাম করে সেই অশ্বথতলায় হাজির হলেন। রাজা বললেন, ‘অশ্বথ ঠাকুর ঢুলির বিচার কর।’
অশ্বথ ঠাকুর নাপিতকে বললেন- ‘নাপিত, ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দাও।’ নাপিত ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দিল। চারদিকে ঢাক-ঢােল বেজে উঠল, রাজার কান জোড়া লেগে গেল। এমন সময় যে হনুমান রাজার কান ছিঁড়েছিল সে এসে বললে- ‘অশ্বথ ঠাকুর, বিচার কর- রাজামশায় আমার কান কেটেছে, আমার কান চাই।।’
অশ্বখ বললে, – ‘রাজা ঢুলির অন্য কান কেটে হনুকে দাও। এক কান কাটা থাকলে বেচারির বড়াে অসুবিধা হত- দেশের বাইরে দিয়ে যেতে হত। এইবার ঢুলির দু-কান কাটা হল- সে এখন দেশের ভিতর দিয়ে যেতে পারবে।’
রাজা এক কোপে ঢুলির আর-এক কান কেটে হনুর কানে জুড়ে দিলেন আবার ঢাক-ঢােল বেজে উঠল। তখন অশ্বথ ঠাকুর বললে, – ‘ঢুলি এইবার ঢােল বাজা।’ ঢুলি লজ্জায় ঘাড় হেট করে ঢােল বাজাতে লাগল- ঢােল বাজছে
‘‘ঢুলির কান কাটা।
ঢুলির কান কাটা।।’
রাজা ফুল-চন্দনে অশ্বথ ঠাকুরের পুজো দিয়ে ঘরে ফিরলেন। রানী রাজার কান দেখে বললেন— ‘একটি কান কিন্তু কালাে হল।’
রাজা বললেন— ‘তা হােক, কাটা কানের থেকে কালাে কান ভালাে। নেই মামার চেয়ে কানা-মামা ভালাে।’