অন্ধবধূ
– যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পায়ের তলায় নরম ঠেকল কি!
আস্তে একটু চল না ঠাকুর-ঝি—
ওমা, এযে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইত বলি, বসে’ দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল—মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল কতই মনে হয় |
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরী ভাই—
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
—অনেক দেরী? কেমন করে’ হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিণ হাওয়া—বন্দ কবে ভাই ;
দীঘির ঘটে নতুন সিঁড়ি জাগে—
শেওলা-পিছল—এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়—
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে’ যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কি আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা—দাদা ত তোর আগে ;
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ী আসার পথ খুঁজে’ না পাবে—
দেখবি তখন প্রবাস কেমন লাগে?
—কি বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকেই যায় ত পরবাসে—
কাল-বোশেখে কে না বাড়ী আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভাইয়ের সবই স্বতন্তর—
ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ!
—ঐ য়ে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে—
ফিরে’ আসতে হবে ত তার কাছে!
এইখানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল ভারি — ফস্ কে যদি যাই—
এ অক্ষমার রক্ষা কি আর আছে!
আসুন ফিরে’—অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা—
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্মশোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’—
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে |
“চোখ গেল” ঐ চেঁচিয়ে হ’ল সারা!
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা—
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার—ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
“চোখ গেল” —তার ভরসা তবু আছে—
চক্ষুহীনার কি কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাডি—
সেই ত ফিরে’ যাব আবার বাড়ী,
একলা থাকা সেই ত গৃহকোণ—
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে—
দরদ-ভরা দুখের আলাপন ;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মত
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে—
বন্দ চোখের অশ্রু রুধি’ পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চিরবিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে—
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!
দেখিস তখন, কাণার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয়না যেন তাঁর |
তার পরে—এই শেওলা-দীঘির ধার—
সঙ্গে আসতে বলবো নাক আর,
শেষের পথে কিসের বল’ ভয়—
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে—
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়!
শেওলা-দীঘির শীতল অতল নীরে—
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে’!