সুজন হরবোলা
– সত্যজিৎ রায়
॥ ১ ॥
সুজনের বাড়ির পিছনেই ছিল একটা সজনে গাছ। তাতে থাকত একটা দোয়েল। সুজনের যখন আট বছর বয়স তখন একদিন দোয়েলের ডাক শুনে সে ভাবল—আহা, এ পাখির ডাক কেমন মিষ্টি। মানুষে কি কখনো এমন ডাক ডাকতে পারে? সুজন সেইদিন থেকে মুখ দিয়ে দোয়েলের ডাক ডাকার চেষ্টা করতে লাগল। একদিন হঠাৎ সে দেখল যে সে ডাক দেবার পরেই দোয়েলটা যেন তার ডাকের উত্তরে ডেকে উঠল। তখন সে বুঝল যে এই একটা পাখির ডাক তার শেখা হয়ে গেছে। তার মা দয়াময়ীও শুনে বললেন, ‘বারে খোকা, মানুষের গলায় এমন পাখির ডাক ত শুনিনি কখনো!’ সুজন তাতে যারপরনাই খুশি হল।
সুজন দিবাকর মুদির ছেলে। তার একটা বড় বোন ছিল, তার বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটা বড় ভাই মারা গেছে তিন বছর বয়সে। সুজন তাকে দেখেইনি। সুজনের মা খুব সুন্দরী, সুজন তার মতো নাক-চোখ পেয়েছে, তার রঙটাও বেশ পরিষ্কার।
দিবাকরের ইচ্ছা ছেলে লেখাপড়া শেখে, তাই সে সুজনকে হারাণ পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দিল। কিন্তু পড়াশুনায় সুজনের একেবারেই মন নেই। পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় বসে থাকে আর এ গাছ সে গাছ থেকে পাখির ডাক শুনে মনে মনে ভাবে এসব ডাক সে গলায় তুলবে। গুরুমশাই পাঁচের নামতা বলতে বললে সুজন বলে, ‘পাঁচেক্কে পাঁচ, পাঁচ দুগুণে বারো, তিন পাঁচে আঠারো…’। গুরুমশাই তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেন, সেই অবস্থায় সুজন শালিক বুলবুলি চোখ-গেল পানকৌড়ির ডাক শোনে আর ভাবে কখন সে পাঠশালা থেকে ছুটি পেয়ে এই সব পাখির ডাক নকল করতে পারবে।
তিন বছর পাঠশালায় পড়েও যখন কিছু হল না তখন একদিন হারাণ পণ্ডিত দিবাকরের দোকানে গিয়ে তাকে বলল, ‘তোমার ছেলের ঘটে বিদ্যা প্রবেশ করানো শিবের অসাধ্য। আমি বলি কি তুমি ছেলেকে ছাড়িয়ে নাও। তোমার কপাল মন্দ, নইলে তোমার এমন ছেলে হবে কেন? অনেক ছেলেই ত দিব্যি লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে যাচ্ছে।’
দিবাকর আর কী করে, ছেলেকে ডেকে জিগ্যেস করল, ‘অ্যাদ্দিন পাঠশালায় গিয়ে কী শিখলি?’
‘আমি বাইশ রকম পাখির ডাক শিখেছি, বাবা’, বলল সুজন। ‘আমাদের পাঠশালার পিছনে একটা বটগাছ আছে, তাতে অনেক রকম পাখি এসে বসে।’
‘তা তুই কি হরবোলা হবি নাকি? জিগ্যেস করল দিবাকর।
‘হরবোলা? সে আবার কি?’
‘হরবোলারা নানারকম পাখি আর জন্তু-জানোয়ারের ডাক মুখ দিয়ে করতে পারে। তারা এইসব ডাক ডেকে লোককে শুনিয়েই রোজগার করে। তোর যখন পড়াশুনা হল না, তখন দোকানে বসেও তুই কিছু করতে পারবি না। হিসেব যে করবি, সে বিদ্যে ও ত তোর নেই। তাই তোকে আমার কোনো কাজে লাগবে না।’
সুজন সেই থেকে হরবোলা হবার চেষ্টায় লেগে গেল। তার কাজ মাঠে ঘাটে বনবাদাড়ে ঘোরা, আর পাখির ডাক শুনে, জানোয়ারের ডাক শুনে, সেই ডাক মুখ দিয়ে নকল করা। এই কাজে তার ক্লান্তি নেই,কারণ তার স্বাস্থ্য বেশ ভালো, অনেক হাঁটতে পারে, গাছে চড়তে পারে, সাঁতার কাটতে পারে। তার ডাকে যখন পাখি উত্তর দেয়, তখন তার মনটা নেচে ওঠে। মনে হয় সব পাখিই তার বন্ধু। খোলা মাঠে গিয়ে বসে গরু বাছুর ছাগল ভেড়ার ডাক সে তুলেছে, তারা তার ডাকে জবাব দেয়। তার হাম্বা ডাক শুনে নিস্তারিণী বুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ধবলীর বাছুরটা হঠাৎ ফিরে এল ভেবে; তার গাধার ডাক শুনে মোতি ধোপার গাধা ঘাড় তুলে কান খাড়া করে ডাকতে শুরু করে, মোতি ভাবে আরেকটা গাধা এল কোত্থেকে। ঘোড়ার চিঁহিতেও সুজন ওস্তাদ, সেটা সে ডাকে জমিদার হালদারের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। সে ডাক শুনে সহিস করিমমিঞা ভাবে, কই, আমার ঘোড়া ত ডাকছে না—এটা আবার কার ঘোড়া?
আর পাখির কথাই যদি বল, তাহলে সুজন অন্তত একশো পাখির ডাক তুলেছে। কাক চিল চড়ুই শালিক কোয়েল দোয়েল পায়রা ঘুঘু তোতা ময়না বুলবুলি টুনটুনি চোখ-গেল কাদাখোঁচা কাঠঠোকরা হুতোম প্যাঁচা—আর কত নাম করব? সুজন এইসব পাখির ডাক তুলে নিয়েছে এই গত কয়েক বছরে। সে ডাক শুনে পাখিরাই যদি ভুল করে তাহলে মানুষের আর কী দোষ?
বয়স কত হল সুজনের? তা হয়েছে মন্দ কী। তাকে আর খোকা বলা যায় না, সে এখন জোয়ান। সে গতরে বেড়েছে, সবল সুস্থ শরীর হয়েছে তার। বাবা বলে, তুই এবার কাজে লেগে পড়। রোজগারের বয়স হয়েছে তোর। কার্তিক হরবোলা থাকে এই পাশের গাঁয়ে। তাকে গিয়ে বল তোর একটা হিল্লে করে দিতে। না হয় তার সঙ্গে রইলি কটা দিন; তারপর আরেকটু বয়স হলে নিজের পথ দেখবি।
বাপের কথা শুনে সুজন কার্তিক হরবোলার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। কার্তিকের বয়স হয়েছে দুকুড়ির উপরে—সে বিশ বছর হরবোলার কাজ করছে। কিন্তু সুজন দেখল সে নিজে যতরকম ডাক জানে, কার্তিক তার অর্ধেকও জানে না। সুজন এই কিছুদিন হল নাকী সুরে মুখ দিয়ে সানাই বাজাতে শিখেছে, তার সঙ্গে ডুগী তবলা সে নিজেই বাজায়; শিঙে ফোঁকার আওয়াজও শিখেছে, নাচের সঙ্গে যে ঘুঙুর বাজে সেই ঘুঙুরের আওয়াজ করতে শিখেছে মুখ দিয়ে। কার্তিক এসব কিছুই জানে না। সে সুজনের কাণ্ড দেখে হাঁ। তবে মুখে কিছু বলল না, কারণ কার্তিকের হিংসে হচ্ছিল। সে শুধু বলল, ‘আমি সাকরেদ নিই না। তোমার যা করার তা নিজেই করতে হবে।’
সুজন বলল, ‘আজ্ঞে আপনি কি করে শুরু করলেন তা যদি বলেন তাহলে আমার একটু সুবিধে হয়।’
তাতে কার্তিকের আপত্তি নেই। সে বলল, ‘আমি তেরো বছর বয়সে যন্তিপুরের রাজবাড়িতে গিয়ে হরবোলার খেলা দেখাই। রাজা খুশি হয়ে আমাকে ইনাম দেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে যায়। তুই কোনো রাজাকে খুশি করতে পারিস ত তোরও একটা গতি হয়ে যাবে। আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব নয়।’
সুজন আর কী করে? সে কাউকে চেনে না, কোথাকার কোন রাজবাড়িতে গিয়ে খেলা দেখাবে সে? মনের দুঃখে সে বাড়ি ফিরে এল।
সুজনের গ্রামের নাম হল ক্ষীরা। ক্ষীরার উত্তরে তিন ক্রোশ দূরে একটা বড় মাঠ পেরিয়ে ছিল একটা গভীর বন। এই বনের নাম চাঁড়ালি। চাঁড়ালির বনে যত পাখি আর জানোয়ারের বাস তেমন আর কোনো বনে ছিল না। সুজন একদিন দিন থাকতে থাকতে সেই বনে গিয়ে হাজির হল। জানোয়ারে তার কোনো ভয় নেই, আর পাখিতে ত নে-ই-ই। এই বনে গিয়ে তিনটে নতুন নাম-না-জানা পাখির ডাক সে তুলল। সূর্যি যখন মাথার উপর থেকে পশ্চিমে নামতে শুরু করেছে, এমন সময় সুজন শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের শব্দ, আর দেখল এক পাল হরিণ ছুটে পালিয়ে গেল।
কিছু পরেই সুজন দেখল যে বনের মধ্যে দিয়ে আসছে ঘোড়ার পিঠে এক রাজা, আর আরো পাঁচ-সাতটা ঘোড়ায় তার অনুচরের দল। দেখে সে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, কারণ বনে অন্য মানুষ দেখবে সেটা সে ভাবেনি। এটা সে ভালোই বুঝল যে রাজা মৃগয়ায় বেরিয়েছেন।
এদিকে রাজাও সুজনকে দেখে অবাক।
‘তুই কে রে?’ রাজা হাঁক দিয়ে জিগ্যেস করলেন ঘোড়া থামিয়ে।
সুজন হাত জোড় করে নিজের নাম বলল।
‘তুই একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তোর বাঘের ভয় নেই?’
সুজন মাথা নেড়ে না বলল।
‘তার মানে কি এ বনে বাঘ নেই?’ রাজা জিগ্যেস করলেন। ‘শুনেছিলাম যে চাঁড়ালির বনে অনেক বাঘের বাস?’
‘বাঘ আপনার চাই?’
‘চাই বৈ কি। শিকারে এসেছি দেখতে পাচ্ছিস না? বাঘ ছাড়া কি শিকার হয়?’
‘বাঘ খুঁজে পাননি আপনারা?’
‘না, পাইনি। হরিণ ছাড়া আর কিছুই পাইনি।’
‘ও।’
সুজন একটুক্ষণ ভাবল; তারপর বলল, ‘বাঘ আছে, আর সে বাঘের ডাক আমি শুনিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আপনি কি সে বাঘ মারবেন, রাজামশাই?’
‘মারব না? শিকার মানেই ত জানোয়ার মারা।’
‘কিন্তু বাঘ আপনার কী ক্ষতি করল যে তাকে মারবেন?’
রাজা আসলে খুব ভালো লোক ছিলেন। তিনি একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, ‘বেশ, আমি তোর কথা মানলাম। বাঘ আমি মারব না, কারণ সত্যিই সে আমার কোনো অনিষ্ট করেনি। কিন্তু সে যে আছে তার প্রমাণ কই?’
সুজন তখন দুহাত চোঙার মতন করে মুখের ওপর দিয়ে সামনের দিকে শরীরটাকে নুইয়ে একটা বড় দম নিয়ে ছাড়ল একটা হুঙ্কার। অবিকল বাঘের ডাক। আর তার এক পলক পরেই বনের ভিতর থেকে উত্তর এল, ‘ঘ্যাঁয়াঁওঁ!’
রাজা ত তাজ্জব।
‘তোর ত আশ্চর্য ক্ষমতা,’ বললেন রাজা। ‘তুই থাকিস কোথায়।’
‘আজ্ঞে আমার গাঁয়ের নাম ক্ষীরা। এখান থেকে তিন ক্রোশ পথ।’
‘তুই আমার সঙ্গে আমার রাজ্যে যাবি? তার নাম জবরনগর। এখান থেকে ত্রিশ ক্রোশ। আমার মেয়ের বিয়ে আছে সামনের মাসে আজবপুরের রাজকুমারের সঙ্গে। সেই বিয়েতে তুই হরবোলার ডাক শোনাবি। যাবি?’
‘আজ্ঞে বাড়িতে যে বলতে হবে আগে।’
‘তা সে তুই আজ বাড়ি চলে যা। আমরা বনে তাঁবু ফেলেছি। সেখানে রাত কাটিয়ে কাল সকালে ফিরব। তুই কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসিস বাড়িতে বলে।’
‘বেশ তাই হবে।‘