গুরুচন্ডালী – শিবরাম চক্রবর্তী

গুরুচন্ডালী
– শিবরাম চক্রবর্তী

সীতানাথবাবু ছিলেন সেকেন্ড পন্ডিত, বাংলা পড়াতেন। ভাষার দিকে তাঁর দৃষ্টি একটুও ভাসা-ভাসা ছিল না-ছিল বেশ প্রখর। ছেলেদের লেখার মধ্যে গুরুচন্ডালী তিনি মোটেই সইতে পারতেন না।

সপ্তাহের একটা ঘণ্টা ছিল ছেলেদের রচনার জন্যে বাঁধা। ছেলেরা বাড়ি থেকে রচনা লিখে আনত- একেক সময়ে ক্লাসে বসেও লিখত। সীতানাথবাবু সেইসব রচনা পড়তেন, পড়ে-পড়ে আগুন হতেন। ছাত্রদের সেই রচনা পরীক্ষা করা, সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতোই একটা উত্তপ্ত বিষয় ছিল সীতানাথবাবুর কাছে। যেমন তাঁর তেমনি আমাদেরও। এত করে বকেঝকেও গুরুচন্ডালী দোষ যে কাকে বলে ছাত্রদের তিনি তা বুঝিয়ে উঠতে পারেননি-উক্ত দোষমুক্ত করা তো দূরে থাক।

সেদিনও তিনি ক্লাসসুদ্ধ ছেলের রচনা খাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে-দেখতে তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠল, হাতের দু-রঙা পেনসিলের লাল দিকটা ঘসঘস করে চলতে লাগল খাতার ওপর- রচনার লাইনগুলো ফসফস করে লাল দাগে কেটে-কেটে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। এর চেয়ে ছেলেদের চাবুকে লাল করা যেন সোজা অনেক-ছিল ঢের আরামের-আর তা করতে পারলে যেন গায়ের ঝাল মিটত তাঁর। খাতাগুলো পাশে সরিয়ে রেখে তিনি বললেন-‘এ আর কী দেখব! খালি গুরুচন্ডালী। কতবার করে বলেছি, হয় সাধুভাষায় লেখো, নয়তো কথ্যভাষায়। যেটাতেই লেখো তা ঠিক হবে। কিন্তু একরকমের হওয়া চাই। সাধুভাষায় আর কথ্যভাষায় মিশিয়ে খিচুড়ি পাকানো চলবে না। না, কিছুতেই না। কিন্তু এখনো দেখছি সেই খিচুড়ি-সেই জগাখিচুড়ি।’

গণেশ বললে-‘আমি সাধুভাষায় লিখেছি স্যার।’

‘সাধুভাষায় লিখেছ? এই তোমার সাধু সাধুভাষা?’ সীতানাথবাবু গাদার ভেতর থেকে তার খাতাটা উৎখাত করেন-‘কী হয়েছে এ? ‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় সে ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িল’?’

‘দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে-‘কেন স্যার, ‘করিয়া’ তো দিয়েছি আমি। করিয়া কি সাধুভাষা হয়নি স্যার?’

‘কিন্তু ধপাস? ধপাস কী ভাষা? দুগ্ধফেননিভের পরেই এই ধপাস?’

গণেশ এবার ফেননিভের মতোই নিভে যায়, টুঁ শব্দটি করতে পারে না।

‘কতবার বলেছি তোমাদের যে, ভাষায় খিচুড়ি পাকিয়ো না। হয় সাধুভাষায় নয় কথ্যভাষায়- যেটায় হয় একটাতে লেখো। কিন্তু দেখো, আগাগোড়া যেন একরকমের হয়।-গণেশের এই বাক্যটিতে তোমাদের মধ্যে নিখুঁত করে বলতে পারো কেউ?’

‘পারি স্যার।’ মানস উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দাঁড়িয়েই মাথা চুলকোতে লাগল সে। ধপাস-এর সাধুভাষা কী হবে তার জানা নেই। খানিক মাথা চুলকে আমতা-আমতা করে সে নিজেও ধপাস করে বসে পড়ল। তার মানসে যে কী ছিল তা জানা গেল না। সরিৎ উঠে বলল, ‘কিসে বলব স্যার? কথ্য ভাষায়, না অকথ্য ভাষায়?

‘যাতে তোমার প্রাণ চায়।’

‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়েস করে বসল।’

‘দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে আয়েস?’ সীতানাথ বাবুর মুখখানা-উচ্ছের পায়েস খেলে যেমন হয় তেমনিধারা হয়ে উঠে : ‘ওহে বাপু! গুরুচন্ডালী কাকে বলে তা কি তোমাদের মগজে ঢুকেছে? মনে করো যে, যে-চাঁড়ালটা আমাদের এই স্কুলে ঝাঁট দেয়, সে যদি হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে একাসনে বসে, তাহলে সেটা দেখতে কেমন লাগে? সেটা যেমন দৃষ্টিকটু দেখাবে, কতকগুলি সাধু-শব্দের মধ্যে একটা অসাধু-শব্দ ঢুকলে ঠিক সেইরকম খারাপ দেখায়, তাই না? সাধুভাষার শব্দ যে কথ্যভাষার শব্দের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসতে পারে না, সেই কথাই আবার অন্যান্য সাধু-শব্দের সঙ্গে মিশ খেয়ে বেশ মানিয়ে যেতে পারে। যেমন উদাহরণস্বরূপ-’

‘বলব স্যার? এতক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি।’ বলে ওঠে গণেশ : ‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়াস-সহকারে বসিল। কিম্বা উপবেশন করিল।- হয়েছে স্যার এবার?’

‘কিংবা আরও বেশি সাধুতা করে আমরা বলতে পারি-’ নিরঞ্জন উঠে দাঁড়ায় : ‘আসন গ্রহণ করিল। কিংবা আসন পরিগ্রহ করিল।’

পোস্টটি শেয়ার করুন