এক বছরের রাজা – সুকুমার রায়

এক বছরের রাজা
লেখক- সুকুমার রায়

এক ছিলেন সওদাগর- তাঁর একটি সামান্য ক্রীতদাস তার একমাত্র ছেলেকে জল থেকে বাঁচায়। সওদাগর খুশি হয়ে তাকে মুক্তি তো দিলেনই, তা ছাড়া জাহাজ বােঝাই করে নানা রকম বাণিজ্যের জিনিস তাকে বকশিশ দিয়ে বললেন, “সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে যাও- এই সব জিনিস বেচে যা টাকা পাবে, সবই তোমার।” মনিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে জাহাজে চড়ে রওনা হল বাণিজ্য করতে।

কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙে-চুরে জিনিসপত্র লােকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।

ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সাথের লােকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন- তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লােক বার হচেছ। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লােকেরা চিল্কার করে বলল, “মহারাজের শুভাগমন হােক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।” তারপর সবাই তাকে খাতির করে জমকালাে গাড়িতে চড়িয়ে, প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলাে তাড়াতাড়ি রাজপােশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।

সবাই বলছে, ‘মহারাজ’, ‘মহারাজ, হুকুম মাত্র সবাই চটপট কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন- বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লােকদের বলল, “এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় ‘মহারাজ’ বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?”

তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়াে উঠে বলল, “মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষেরই মতো। অনেকদিন আগে আমরা মানুষ রাজা’ পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ, মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি করে মানুষ এইখানে আসে, আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে করে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, যেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নুতন রাজা আসে- এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।”

তখন দাসরাজা বললেন, “আচছা বল তো- এর আগে তোমাদের রাজারা কী রকম স্বভাবের লােক ছিলেন?” বুড়াে বলল, “তারা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খাম খেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমকে আমােদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন- বছর শেষে কী হবে কেউ সে কথা ভাবতেন না।”

নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কী হবে এই কথা ভেবে কদিন তার ঘুম হল না!

তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি করে বললেন, “আপনারা আমাকে উপদেশ দিন- যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।”

তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, “মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সেই দেশে যেতে হবে। কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচছা হয় তাই করাতে পারেন। আমি বলি- এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লােকদের সেই দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি করে, বাগান করে, চাষবাসের ব্যবস্থা করে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফুলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লােকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক করে নিন।” রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লােকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছের চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকজা পাঠিয়ে আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।

তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র, মুকুট, রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তার রাজার পােশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নাই চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লােকে লােকারণ্য। তারা সবাই এসে আনন্দের সাথে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে আজীবন রাজত্ব করতে লাগলেন।

 

(পরিমার্জিত)


পোস্টটি শেয়ার করুন