দুই মুসাফির – শওকত ওসমান

দুই মুসাফির
– শওকত ওসমান

গ্রীষ্মের দুপুর প্রায় শেষ। অড়হর খেতে ছায়া পড়ছে। ক্রমশ দীর্ঘতর। কুষ্টিয়া জেলাবোর্ডের সড়ক পথে একজন পথিক হাঁটছিলেন। পরনে গেরুয়া তহবন্দ, গায়ে গেুরুয়া আলখেল্লা। লম্বাটে মুখবোঝাই সাদা দাড়ি। হাতে একটা একতারা। পথিক ঘর্মক্লান্ত। তবু দুই চোখ পথের ওপর নয়, পথের দু ধারে। গ্রীষ্মের দাবদাহ সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। এই রুক্ষতার সৌন্দর্য বৈরাগীর মনের রঙের মতো। পথিক তাই চেয়ে চেয়ে দেখছেন আর হাঁটছেন। মাঝে মাঝে একতারায় হঠাৎ আঙুল অজানিতে গিয়ে পড়ে। টং টাং আওয়াজ রৌদ্রের বিবাগী সুরে মিশে যায়। তা নিতান্ত অজানিতে। নচেৎ পথিকের মন একতারার সুরে নয়, বহির্বিশ্বের ফ্রেমে আবদ্ধ। মাঝে মাঝে ছায়াবতী গাছ পড়ে কিনতু মুসাফির থামেন না। তিন মাইল দূরে গঞ্জ দেখা যায়। সেখানেই হয়তো তার গন্তব্য।

পেছনে আর একজন হাঁটছেন। একটু দ্রুত। তার ইচ্ছা অগ্রগামী পথিকের সঙ্গ ধরা। ডাক দিয়ে হয়তো চলা থামানো যায়। কিনত এ মুসাফির অত দূরে গায়ে-পড়া ভাব দেখাতে রাজি নন। তা ছাড়া এই মহাজনের চেহারায় রুক্ষ-কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট, তাঁর কালো গুরাশি এবং সুঠাম ললামপূর্ণ দুই বাহুর মধ্যে মুখটি বেশ চওড়া। চোখ গোল- ভাটার মতো। দেখলেই মনে হয়, এই মানুষ তুকম দিতে অভ্যস্ত, তামিলে নয়। কিন্তু তিনি হাঁটছেন জোর-পা। অগ্রগামী পথিককে ধরা উচিত। পথচলার ক্লান্তি দূর করতে সঙ্গীর মতো আর কিছুই নেই। দ্বিতীয় পথিক জোরে হাঁটতে লাগলেন। ফলে ঘাম ঝরে তার শরীর থেকে। মুখে অসোয়াতি ছাপ পড়ে। কিনতু তবু সংকল্প টলে না।

কাছাকাছি এসে দ্বিতীয় পথিক ডাক দিলেন, ও ভাই! আগের পথিক এবার পেছনে তাকান। অন্য মানুষ দেখে মুখে অভিনন্দনের হাসি, থামলেন প্রথম পথিক।

পেছনে ফিরে বললেন, আমাকে ডাকছেন, ভাই ?

-জি, স্লামালেকুম।

-অলাইকুম আসসালাম।

-আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন?

-ঐ গঞ্জে।

-বেশ বেশ। আমিও যাব। বেশ ভালোই হল।

চলুন একসঙ্গে, কথা-বার্তায় যাওয়া যাবে। 

দুজনে এগোতে থাকেন। এবার কিন্তু দুজনেরই পদক্ষেপ শ্লথ। সঙ্গী পেলে পথের দূরত্ব আর ভীতিজনক থাকে না। তাই হয়তো তাঁরা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। দুজনে পাশাপাশি। দাড়িশোভিত পথিকের দৃষ্টি বাইরের দিকে। গুধারী মুসাফির কিনতু সঙ্গীর দিকে বারবার তাকান। গ্রীষ্মে দিগন্ত আলোর তীব্রতায় মুহ্যমান। সেই রূপ সবসময় পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় মুসাফির সেদিকে তাকিয়ে সঙ্গীর চোখের দৃষ্টি কোথায় মিশেছে দেখতে চান। সেই দৃষ্টি দিগন্ত অভিমুখী। দ্বিতীয় মুসাফির তাই কয়েকবার দূরে তাকিয়ে আবার সঙ্গীর অবয়বের দিকে লক্ষ করেন। অপরজন নির্বিকার।

এই নিস্তব্ধতা দ্বিতীয় পথিকের কাছে অসহ্য লাগে। কথায় বন্ধন না এলে আর বন্ধ কী? গুমোট দূর করতে তিনি বেশ উঁচ আওয়াজেই বলেন, ভাই আপনি কি গান করেন। সদ্য চমক-ভাঙা প্রথম আনমনা মুসাফির শুধান, কী ভাই, আমাকে কিছু বলছিলেন?

-জি

-কী, বলুন?

-আপনি কি গান করেন?

-জি, করি।

তবে একটা গান করুন না, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।

-না, অসুবিধা আর কী। তাহলে শুনুন।

-গেরুয়াবসন পথিক একতারার সাজ ঠিক করে নিলেন। তারপর গান ধরলেন : 

দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম
আজব কারখানা।।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে,
সেই বাড়িতে চোর লেগেছে,
ছয়জনাতে সিঁদ কাটিছে,
চরি করে একজনা।।
দেহের মাঝে বাগান আছে
নানা জাতি ফুল ফুটেছে।
ফুলের সৌরভে জগৎ মেতেছে।
কেবল লালনের প্রাণ মাতল না।।

নির্জন মাঠ সুরের ঝরনাধারা থেকে পানীয় ঠোঁটে নিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। দাবদাহ দূরে সরে যায়। সুরের মোড়কে পৃথিবী যেন শরণার্থী। কখন গান থেমে যায়, কেউ লক্ষ করে না। কারণ, পথের সঙ্গে পায়ের হদিস ঠিক ছিল। দ্বিতীয় পথিক এই রেশে আঘাত দিলেন।

-আহ, চমক্কার গান গানতো আপনি।

-জি?

চমক্কার আপনার গান।

-জি, এ আর কী।

-না, না। সত্যি সুন্দর গলা আপনার। আমি এ গান আর কখনও শুনিনি।

-কখনও শোনেননি?

-না।

-বেশ। 

দুজনের মধ্যে আর কোনো বাক্যালাপ হয় না। তাড়াতাড়ি পথ শেষ করাই তখন লক্ষ্য।

মাঠ শেষ হয়ে গেল। তারা দুই জনে এখন লোকালয়ের মধ্যে এসে পড়েছেন। গাছ-গাছালির মাঝখানে খড়াে বাড়ি, টিনের ঘর , কৃচিৎ ইমারত দেখা যাচ্ছে। সড়কের দু পাশে এখানে বহু গাছের সারি। দু একজন পথিক যে য যাচ্ছে, এদের দিকে কেউ তাকায় না। তবু মানুষের সঙ্গ পাওয়া গেল, প্রথম মুসাফির ভাবলেন। 

তারা এবার একটা জায়গায় এসে পড়েছেন। এখানে সড়কের দু পাশ ফাঁকা। তারপরই অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ভিটা, পুকুর পুষ্করিণী। এক জায়গায় জড়াজড়ি করা কয়েকটা ইমারত দেখা গেল, বেশ বড় বাগানের ফলের গাছের সারির ভেতর দিয়ে।

দ্বিতীয় পথিকের সেদিকে চোখ পড়া মাত্র তিনি বৈরাগী পথিকের হাত ধরে টান দিলেন, আর বললেন- একটু জলদি আসুন, ঐ আমার ঘর দেখা যাচ্ছে, ঐ আমার বাগান। এই চারদিকে যত জমি-জিরাত সব আমার। চলুন, চলুন। আপনাকে ঐ যে নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছে ওখান থেকে যা ডাব খাওয়াব,সাত দিনের পিয়াস মরে যাবে।

প্রথম মুসাফির আর জবাব দেওয়ার অবসর পান না। দ্বিতীয় পথিকের মুঠির মধ্যে তাঁর হাত বাঁধা। দ্রুত হাঁটতে তাই বাধ্য হচ্ছেন। দুই জনে এসে একটা পাকা সান-বাঁধানো দিঘির ধারে থামলেন। পাড়ে শত শত নারকেল গাছ। 

দ্বিতীয় পথিক বললেন, এখানে বসুন। এই কামিনী গাছের ছায়ার নিচে। আমি ডাবের বন্দোবস্ত করি। এই সব আমার। এই দিঘি, আগান-বাগান, ওই ইমারত আর ওপাশে মাঠে চোখ যদুর যায়, সমস্ত আবাদি জমি আমার। আর এই যে- পথিকের কথা সমাপ্ত হয় না। এরা লক্ষ করেন নি সানবাঁধা ঘাটের একপাশে দুটো নারিকেল গাছের আড়ালে আর একজন বেশ মোটা তেজীয়ান, গোঁফবান ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ বেরিয়ে এলেন একদম দুজনের মুখোমুখি।

পোস্টটি শেয়ার করুন